ছাগলের ঘানি টানা
আমরা কি ধান গাছের তক্তা দিয়ে বানানো তক্তপোষে আকন্দ গাছের ছায়ায় বসে সোনার পাথর বাটি তে কাঁঠালের আম সত্ত খেতে খুব ভালো বাসি আর কিছু মানুষ সেটাই খাইয়ে খাইয়ে আমাদের বোঝাতে থাকে যে আমাদের পেট ভরা আছে। এরা খরগোশ দিয়েই ঘানি টানিয়ে সর্ষের তেল বার করার কথা বলে।
নিজের মাঝারি সাইজের ফ্যাক্টরি তে বসে কাজ করছি। বলতে গেলে ম্যানেজিং ডিরেক্টর, অনেক সময় মনে হয়ে বলদ হয়ে যেন শুধু ঘানি টেনে যাচ্ছি। কথায় বলে ঢেকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে, আমার ও প্রায় সেই এক অবস্থা। যখন পরের চাকরি ছিল, তখন তার ঘানি টেনে গেছি, আর এখন ও টেনে যাচ্ছি, পরিবর্তন শুধু এই যে ঘানি টা নিজের নামের, তাই তেলের ঝাঁঝ তো নিজেকেই বেশি করে সহ্য করতে হবে । তা আমার দেশের যা অবস্থা, আমার থেকে আমার চাকুরী করে যে তার সম্মান বেশি। সে দুঃখ তো রাখার জায়গা নাই, করিয়া কোনো লাভ নাই।
হাওড়া বর্ধমান মেন্ লাইনে যেখানে গন্ডায় গন্ডায় ফ্যাক্টরির দরজায় তালা ঝুলছে, সেইখানে আমার ফ্যাক্টরি তা চালিয়ে যাবার পরিশ্রম করে যাই। শুধু একটা দিন খুব ভালো লাগে, যেদিন ২৫০ কর্মচারী কে মাইনে টা দি। সে দিন মনে হয়, ঈশ্বরের অসীম আশীর্বাদ যে আমি এতো গুলো মানুষের সংসার সাথে নিয়ে চলছি। আমার ফ্যাক্টরি ঠাকুরের ইচ্ছায়, আমার সব কর্মচারীর সাহায্যে আর আমার যুগান্তকারী কিছু নতুন নতুন চিন্তাধারার কারণে মোটামুটি চলে. অনেক সময় অনেক কিছু হয়ে, সব গা সওয়া হয়ে গেছে। তার ই মধ্যে, এক দিন এর ঘটনা।
আমার কুটুমের বাড়ি থেকে ফোন, প্রথমে প্রাথমিক সৌজন্য আলাপ সারা হলো। মনে বিরক্তি আসছিলো, শঙ্কা ও ছিল, বিজয়া, জন্মদিন ছাড়া ফোনে কথা হয়ে না, হঠাৎ অফিস টাইম? এ ফোন খেজুরে আলাপ করতে তো করা হয়নি, অন্য কিছু আসছে, ক্রমশ প্রকাশ্য !
ভাবার মতন ফল ও দেখতে পেলাম, খেজুরে আলাপ সেরে আসল কথা, 'শোনো ভাই, তোমার ফ্যাক্টরির গল্প অনেক শুনি, তা আমার বোনের এক দেওর আছে, গ্রাফিক ডিজাইনিং কোর্স করে এক দম এক্সপার্ট হয়ে গেছে। তার টিচার আর সঙ্গী সাথী খুব প্রশংসা করে তার, কলেজ এ বড়ো বড়ো কোম্পানি থেকে লোক নিতে আসছে, তবে আমরা ওকে বলে রেখেছি যে ওর ওই সব বড়ো কোম্পানি তে গিয়ে কাজ নাই। তোমার ফ্যাক্টরি থাকতে ও অন্য কোথাও কেন যাবে বলো তো ?'
'ও, দেখুন আমার এখন তো কোনো এক্সপার্ট গ্রাফিক ডিজাইনিং এর লোক দরকার নেই। আমার তো খুব ছোট কোম্পানি, তা যদি কলেজ প্লেসমেন্ট এ কোনো কোম্পানি আসে তো তাতেই যাক না। '
' না রে ভাই, নিজের বাড়ির কোম্পানি থাকতে অন্য জায়গায় কেন যাবে? টাকা পয়সার জন্য ভাবতে হবে না বেশি, এই কিছু হাত খরচ দিলেই চলবে। তোমার কাছে যা শিখতে পারবে সেটা তো আর কোথাও হবে না। '
নিজেকে বললাম, এ কি রে, আমি তো এই ক'বছর আগে শুনলাম আমি নাকি আহাম্মক এর মতন কাজ করেছি ফ্যাক্টরি খুলে, তা আমি আবার কি শেখাবো ? প্রকাশ্যে অবশ্য অন্য শব্দ উচ্চারিত হলো আমার মুখ থেকে, 'ঠিক আছে দাদা, একবার পাঠিয়ে দেবেন, বলবেন ফোন করে এসে যাবে, আমি কথা বলে দেখে নেবো। '
'আরে ভাই ফোনে করে যাবার কি আছে, আমি তো ওকে নিয়েই ব্যাস তোমার ফ্যাক্টরি তো এই পৌঁছুবো , এই ধরো ১০-১৫ মিনিট। '
বলা গেলো না এখন আসবেন না, শুরুতেই বলে দিয়েছি ফ্যাক্টরি তে আছি।
প্রায় আধা ঘন্টা পর শ্রীমান কুটুম নিজের বোনের দেওর কে নিয়েই হাজির।
কুটম বলে কথা, ফ্যাক্টরি এলাকার চা এর সাথে দুটো করে সিঙ্গাড়া আর মিষ্টি গঙ্গাপ্রাপ্তি হলো। তার পর আমি সেই ডিজাইনিং ইয়ং ম্যান কে জিগাইলাম, কি কি জানো, কী করতে পারো।
আমার ফ্যাক্টরির ডিজাইনিং টিম এর কারুকে ডাকার দরকার হলো না। বুঝলাম, পেটে বোমা মারলে যদি কটা ডিজাইনিং এর 'ডি' বেরোয়। এটাও বুঝলাম যে কলেজ এ আসা সব কোম্পানি এঁনাকে সসম্মানে নমস্কার করে সরিয়ে দিয়েছেন। কাজ এর ব্যাপার আলাদা, উনি কিসের পরীক্ষা শেষ দিযেছেন তাতেও মনে হলো দ্বিধাগ্রস্ত।
জিজ্ঞেস করলাম কোনো বিষয় কথা বলা যেতে পারে কি? তা উনি বললেন, বিষয় তা আমি দিলে উনি নাকি এক মাস পর আমার কাছে আসবেন সে বিষয় চর্চা করতে। ভবিষ্যৎ এর চিন্তা জিজ্ঞেস করতে বললেন, ইচ্ছা আমার কাছে ছয় মাস কাজ করে কোলকাতা তে নিজের প্র্যাক্টিসে বসবেন।
যথা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে শ্রীমান কুটুম কে বললাম, 'দাদা, আমার কাছে তো এর কাজ হবে না। আমার কাছে শেখাবার সময় নেই, আর এর তো এখনো অনেক কিছু কলেজ এ শেখার আছে। যখন নিজের প্রাকটিস করার ইচ্ছা, তখন কলেজ এর পর কোনো ডিপ্লোমা করিয়ে দেবেন, কাজ করতে সুবিধা হবে। '
শ্রীমান কুটুম এর কটি যুক্তি তক্কো কে পাথর প্রতিম চেহারা করে পাস কাটিয়ে যেতে বললাম, যুক্তি তক্কো গুলো বেরিয়ে গেলো। শ্রীমান ও ক্ষুব্দ হয়ে কিছু কাটা কাটা শব্দ ছুঁড়ে মারলেন, নিজেও কেটে পড়লেন। না, কারো রক্ত ক্ষরণ হয়নি, কমকরে দৃষ্টব্যঃ রক্তক্ষরণ হলো না কাটা কাটি তে।
রাত এ বাড়ি ফিরে এর ঘাট প্রতিঘাত কিছু তা হবে, আশা ছিল, তাই হলো। তবে এখানে সুবিধা ছিল, চক্ষু লজ্জা তা একটু কম দেখানো যায়।
যুক্তি দিলাম, ফ্যাক্টরি তে আমরা সবাই বলদের মতন খেটে যাই, যেমন রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন, সেই চক্ষু বাঁধা বলদের মতো আমরা ঘানি টেনে যাচ্ছি আর তাতেই এতো গুলো সংসার চলছে । এই শ্রীমান, যিনি কলেজ এর শেষ ধাপে এসে জানেন না উনি কোন পেপার এ পরীক্ষা দিয়েছেন, টিচার রা নাকি পেপার মারকিং করতে জানেন না তাই উনি নম্বর পাননি, আবার নিজের প্রাকটিস করতে চান আমার কাছে কাজ শিখে। আমাদের ঘানি তে তো বলদ চাই, ছাগল দিয়ে আমরা তেল বার করতে পারবো না ।
জুন ২৮ ২০২০
বর্ণনা খুব সুন্দরয়েছে নিজের কাজ করতে এরকম বহু পরিস্থিতি আসে ,তার সাযুদ্ধ যাওয়া জরুরী
ReplyDeleteঅনেক সময় দেখা যায় যে এই রকম হয় হাঁ বা না বলতে খুব মুশকিল হয়ে য়ায়। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete