নীলকন্ঠ যাত্রা

 


(ঘটনা টি আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু এবং দাদা সত্যেন সুর মহাশয়ের কাছে শোনা ওনার বাস্তব বেড়াতে যাওয়ার কথা। আজ ওনার অনুপস্থিতি তে ওনাকে এটা আমার উৎসর্গ। কিছু সংযোজন আছে গল্পের খাতিরে, তার জন্যে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি)


১৯৬৪, দিল্লী তে এসেছি তিন বছর হয়ে গেছে, মাঝে মধ্যেই বন্ধুদের নিয়ে এদিক উদিক ঘুরে আসি দুটো ছুটি এলে। সেরকম ছুটি নিয়ে বেড়ানো হতো না কারণ ছুটি নিয়ে বেরুবার জায়গা একটাই ছিল, কলিকাতা। 

পুজোর সময় বাড়ি ঘুরে এসে আর যাওয়া হয়নি কোথাও। আমি সত্যেন, সাগর, জিতেন, ভোলা আর অরুণ, ক'জনের গ্রুপ টা খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। 

ছয় মাস হতে চললো, দেশে যাবার কোনো আশা নেই,শীত টা কাটিয়ে উঠে গরম এ পা দিয়েছে দিল্লী। মার্চ মাসের কাজ এর ভীড় কাটিয়ে ঠিক করলাম শনি রবি দুদিন এর ছুটির দিন গুলো হৃষিকেশ যাবো। টিকিট আগে থেকে কাটার কোনো কল্পনাও ছিল না। 

১১ই এপ্রিল দ্বিতীয় শনিবার, ১০ তারিখ অফিস থেকে পাঁচ জনেই একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সোজা বাস স্ট্যান্ড এ পৌঁছে গেলাম। দুপুর ৩ টের বাস এ উঠে হৃষিকেশ উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। 

রাস্তায় ঢাবায় বাস যাত্রী দের সাথেই খাবার খেয়ে রাত প্রায় ১০ টায় বাস থেকে নামলাম। একটা ধর্মশালা তে খবর দেওয়া ছিল, জিজ্ঞেস করতে করতে সেখানে চলে গেলাম। খাটের ওপর তোষক আর চাদর দেওয়া ছিল, নিজেদের শাল বার করে গল্পঃ আরম্ভ করে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আমরা, কেউও ঘড়ি দেখিনি। সকাল ৭টায় আঁচ জনে সোজা গঙ্গার ধারে গিয়ে ডুব দিয়ে নিলাম। নাহ্ ফটো তোলার কোনো বেবস্থা ছিলনা, কিন্তু আনন্দের কোনো প্রকার কিছু কম ছিল না। স্নান করে ওখানেই চা, লুচি, আলুর তরকারি খেয়ে অমৃত খাওয়া হলো। 

কথায় জানলাম নীলকন্ঠ মহাদেব বেশি দূর না, পাহাড়ি রাস্তায় উঠে যেতে হবে। পাঁচ যুবক,উৎসাহ কম নেই, আহার করে রওনা হয়ে গেলাম। পরনে জমা প্যান্ট, পায় স্যান্ডেল, হাতে লাঠি কারণ জানি পাহাড় চড়তে হবে।

গঙ্গা পার করেই চড়তে শুরু করলাম অবশ্য কখন সোজা রাস্তা কখন উঁচু আবার নিচুও। ধীরে ধীরে মানুষ জনের দেখা কমতে লাগলো। রোদ মাথার ওপর চড়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলো। গঙ্গা পার করার পর কেউ বলল এই কাছেই, দু ঘন্টা তে পৌঁছে যাবে। দুপুর তিনটে, প্রায় তিন ঘন্টা হাঁটছি, বেশ খানিক পর একজন মানুষের দেখা পাওয়া গেলো। জিজ্ঞেস করতে জানালো, আর আধা ঘণ্টা, ঠিক পথেই যাচ্ছি। 

ওই আধা ঘণ্টা পর পর বেশ কয়েকজন বললো, আর হাঁটতে হাঁটতে দেখি সূর্য প্রায় অস্ত যায়। নীলকন্ঠ মন্দির প্রান্তরে যখন পৌঁছুলাম তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। পাখিরা ঘরে ফিরে কিচির মিচির করে জানান দিচ্ছে, শুভ রাত্রি।

পাঁচজনই সমান ক্লান্ত, চিন্তা মাথায়, পৌঁছে তো গেলাম, ফিরবো কী করে এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। সামনে একটি মন্দির, আর কটা কাঁচা পাকা ঘর। আমাদের দেখেই একজন জিজ্ঞেস করলো, আপনারা এখন কোথায় যাচ্ছেন, কথা থেকে আসছেন। আমাদের জবাব শুনে সে আশ্চর্য। 

জানালো, মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে, আজ আর দর্শন হবে না। আজ ফেরাও অসম্ভব কারণ জঙ্গলে ভাল্লুক আর তেন্দুয়া দুই দেখা গেছে, আর তার ওপর রাতে রাস্তা চিনে যাওয়া টাও সম্ভব নয়। মন্দিরের কর্ণধার ও বেরিয়ে এলেন। দেখলাম বাংলা জানেন, নাম টি বললেন না। গুরু জি বলেই পরিচয়। উনি আমাদের জল দিতে বললেন, আর একজন কে বললেন চা বসাতে। সারা দিনের ক্লান্তির পর দুধে ফোটানো আদা দেওয়া চা মনে হলো অমৃত। এর মাঝেই উনি আমাদের খাবার এর ব্যাবস্থা করতে বললেন। বলে দিলেন, রুটি আর আলু সেদ্ধ ছাড়া কিছু দিতে পারবেন না। গরম জল ও পাওয়া গেলো। 

গরম জল এ হাত পা ভাল করে ধুয়ে ভালো ঘী দেওয়া রুটি আর আলু তরকারি বেশ তৃপ্তি করে খাওয়া হলো। আমাদের যখন খাওয়া দাওয়া শেষ, তখন সবে ৭:৩০, কিন্তু চতুর্দিক নিঝুম। খাওয়া শেষ হয়ে নি, হঠাৎ দূর থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে উঠলো, মানুষ এর ডাক আর সাথেই টিন, ড্রাম ইত্যাদি বাজানো। একটা শুরু হতেই মনে হলো অনেক গুলো দিক থেকে আওয়াজ আসছে। আমরা তো হতভম্ব।

গুরুজী বললেন, মনে হচ্ছে হাতির দল আছে তাই তাদের কে গ্রাম থেকে দূরে রাখার জন্য এটা করতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আসেনা? উনি বললেন, না, এখানে আসেন। এটা ওদের রাস্তায় পড়ে না কারণ এই জায়গা টা তিন দিক ঘেরা। ওরা শুধু সামনে বা ডাইনে বাঁয়ে হাঁটে, পেছন ফেরে না। তবে তেন্দুয়া বা ভাল্লুক এর উৎপাত আছে তাই রাতে কিন্তু বেরুবে না। আসাq

 দূর কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। গুরু জি আমাদের একটা ঘরে বেশ কটা কম্বল দিয়ে রাত কাটাতে বলে নিজের কুটিরে চলে গেলেন। নির্দেশ দিলেন, রাত এ যেনো দরজা খুলে বাইরে না বেরুই। খাবার জল সাথেই দিলেন। প্রস্রাব পেলে তাও যেনো ঘরের একটা কোন দেখিয়ে বললেন, ঐখানে করতে, সকালে উঠে জল ঢেলে দিতে।

আমরা সবাই টর্চ জ্বেলে ঘরটা দেখলাম। ইঁটের দেওয়াল, কিন্তু বেশ কিছু ইঁট সিমেন্ট বা মাটি লাগানো নেই, কোনো জানলা নেই, হাওয়া বাতাস শুধু দরজা দিয়ে, আর যেটা বন্ধ। মেঝে তে খড় পাতা, তার ওপরই কম্বল পেতে কম্বল ঢাকা দিয়ে শুতে হবে। বলিস ছিলনা, চারজনে মাথার তলায় জুতো রেখে শুলাম। জিতেনএর আবার মত বালিশ না হলে ঘুম হয় না। ও দেখল দেওয়ালের নিচের দিকে বেশ কিছু ইঁট শুধু লাগানো আছে, তার থেকে একটা ইঁট নিয়ে তার ওপর কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের ভেতর হয়ে কথা বলতে বলতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার একবার ঘুম ভাঙলো, মনে হলো কিছু একটা আওয়াজ হচ্ছে খড়ের গাদায়, যেনো কিছু চলছে। ভাবলাম, ইঁদুর তো নিশ্চয় হতে পারে, কি আর করা যায়। সর সর করে আওয়াজ আসতে থাকলো, আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরের দিকে ঘুম ভাঙলো, দেখি জিতেন মুখ শুকিয়ে বসে আছে। 

কি হলো, জিজ্ঞেস করলাম। 

বাপ, খুব জোর বেঁচে গেছি, অঘোরে মারা পড়তাম।

কেনো, কি দেখলি।

আর বলিসনা, রাত কটা হবে জানিনা, খুব জোর প্রস্রাব এর চাপ পড়েছে। ভাবলাম, দরজা টা খুলেই পাশেই জল ছেড়ে ঢুকে পড়বো। দরজা খুলে আকাশে তারা গুলোর শোভা দেখে কিছু মুহূর্ত মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বারান্দা থেকে নেমে যেই গাছ টার কাছে গিয়ে ভাবলাম এবার কাজ টা করেফেলি, হঠাৎ পেছনের বড় গাছ থেকে জোর শব্দ আর কিছু একটা ধুপ ধাপ করে নামলো। আমার তো আত্মা রাম খাঁচা ছাড়া, কোনো মতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। জানিনা কোন ভুত, কিন্তু তার পায়ের শব্দ ঘরের সামনে পর্যন্ত শুনেছি। তারপর আর ঘুমোতে পারিনি।

কথাবার্তা শুনে গুরুজীর চেলা দরজা নাড়ল, আর ভেতরে এলো। তাকে ভূতের কথা শোনাতেই সে বললো, আপনাদের তো বলা হয়েছিল বেরুবেন না। বেঁচে গেছেন ভাল্লুক এসেছিল। বাঘ বা তেন্দুয়া এলে বাঁচতেন না।

শুনে তো আমাদের রক্ত শুকিয়ে গেলো। কিন্ত আরো বাকি ছিল।

সব কম্বল পাট করে গোছাতে গিয়ে সে প্রায় আঁতকে উঠলো। দেওয়ালের ইঁট কেনো সরালেন!

আমি বললাম, জিতেন সরালো, কিন্তু কেনো, রাতে ইঁদুর ত মনে হয়েছিল ঘুরছে আর তা তো এই খড়ের বিছানার ভেতর ঘুরতেই পারে। ইঁদুর কি করবে।

ভদ্রলোক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, এখানে ইঁদুর একটাও নেই। রাতে যে শব্দ শুনেছেন সেটা সাঁপের, আর কিছু সাঁপ বিষাক্ত, তার মানে আপনারা রাতে দুটো মারাত্বক ঝুঁকি নিয়েছেন, মহাদেবের কৃপায় বেঁচে গেছেন।

নির্বাক পাঁচজন। নির্দেশ অনুযায়ী উঠে গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে, মন্দির এ দর্শন করে, প্রসাদ খেয়ে হৃষিকেশ এর হাঁটা যাত্রা শুরু করলাম। অনুভব করলাম,মৃত্যুর সঙ্গে রাত কাটিয়ে সবার জিভে আঠা লেগে গিয়েছিল। 

দুপুর কাটিয়ে ধর্মশালায় যখন ঢুকলাম তখন ওখানেও সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ওরা ঠিক করছিল যে বিকেল পর্যন্ত আমরা না ফিরলে পুলিশ এ খবর দেবে। আমাদের অত দেরি করে নীলকণ্ঠ উদ্দেশ্যে যাত্রার কথা শুনে অনেক কথা শোনালো।

যাক, বিশ্রাম এর সুযোগ ছিলনা, জিনিস তুলে বাস ধরে সোজা দিল্লী।

যেখানেই গেছি সেই বয়সে, বাড়ি তে অন্যদের কে গল্পঃ করতাম, কিন্তু এই নীলকন্ঠ মহাদেব দর্শন এর গল্পঃ শুধু এক কথায়, দর্শন করে এসেছি। বাকি ঘটনা পুরোটাই উহ্য থেকেছে চিরকাল। আজ প্রকাশ পেলো।


অনুপ মুখার্জী "সাগর"

2 comments:

  1. Wonderful experìence..God bless.

    ReplyDelete
  2. Narration of the story is quite interesting and read it in one go. 👍

    ReplyDelete

Know Thyself. Only You know yourself through you internal Potency