পয়লা নভেম্বর ১৯৮৪.
দিন টি ভারত বর্ষের স্বাধীনতার সময়ের গণহত্যার পর সব চেয়ে বেশি খারাপ চার দিনের অংশ। সেই সময়ে আমি যা দেখেছি সেটা আমার মানসিক ক্যানভাস এ চিরকালের জন্য আঁকা আছে। সেই ছবিতে টাই তুলে ধরছি, সেদিনের লাস্ট লোকাল।
৩১শে অক্টোবর সন্ধ্যা বেলা একটা অফিস এ কাজ করছি। ১৯৮৪, বাড়ি তে ফোন নেই। টি ভি ও নেই। মোবাইল বা পেজার জন্ম নেয়নি। সকাল বেলা প্রধান মন্ত্রীর ওপর হামলা হয়েছে, দুপুর এ সরকারি ঘোষণা হয়েছে যে উনি মারা গেছেন। আমরা কিছু জানিনা।
সন্ধ্যে বেলা অফিসে থেকে বেরুলাম, দেখলাম রাস্তায় বাস কম। কিছু ত হেঁটে, কিছু টা বাস ধরে সফদর জং এনক্লেভ পৌঁছুলাম। বাসায় গিয়ে জানলাম দিনের ঘটনা, দুর্ঘটনা বিশিদ ভাবে রেডিও তে আসছে। সে সব শুনে, চর্চা করে ঘুমোতে যাওয়া হলো।
পরের দিন, ১লা নভেম্বর, রেডিও তে ঘোষণা হলো সরকারি অফিস কাছারি ব্যাংক ইত্যাদি বন্ধ থাকবে, বাস ট্রেন সব চলবে। সেদিন আমাদের প্রথম বাড়ির ভীত খোঁড়ার দিন ছিল। বাসস্থান থেকে নতুন বাড়ির জমি প্রায় ২৫ কিলোমিটার। যাবার সময় দুটো বাস পাল্টে, ৩০ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম।
এক চৌকিদার রাখা হয়েছিল, সে ছিল, কিন্তু কোনো কাজের মানুষ আসেনি। আমি ১১ টায় পৌঁছে আসে পাশের লোকে দের সঙ্গে আলাপ করলাম। যাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছিল তাদের থেকে কিছু জ্ঞান নিলাম। দুপুরের খাবার ছিল, সেটা খাওয়া হলো। এর ভেতর রাস্তা ঘাট ফাঁকা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে একদম ফাঁকা। দুপুর নাগাদ বেরিয়ে বাস স্টপে। খানিক দাড়িয়ে থাকার পর এক পুলিশ এর গাড়ি এসে বললো এ রাস্তায় বাস বন্ধ, মেন রাস্তায় যেতে। অগত্যা হাঁটতে শুরু করলাম। বয়স তো কম, প্রায় ৬ কিলোমিটার দেড় ঘণ্টায় হেঁটে দিল্লীর মুদ্রিকা মার্গ বা রিং রোড পৌঁছুলাম, পাঞ্জাবি বাগ।
সেখানে দেখি প্রায় ১০০ জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আরো দেখলাম দলে দলে মানুষ হাঁটছে, বাস বা কোনো জন বাহন নেই। খানিক অপেক্ষা করে আমিও হাঁটতে শুরু করলাম। একটা বাস দেখলাম কিন্তু তাতে তিল ধরার ও জায়গা নেই। আরো প্রায় দু ঘন্টা হেঁটে পিপাসায় জিভ তালু তে ঠেকেছে অবস্থা। একটা কলোনির কাছে এসে মনে পড়লো সেখানে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। অগত্যা তার বাড়ি চলে গেলাম। সেখানে মাসিমা চা জলখাবার দিল, বললো রাতে থেকে যেতে পারি। কিন্তু বাড়ি যেতে হবে। কারো কাছে ফোন নেই যে খবর দেওয়া নেওয়া যেতে পারে। হেঁটে যেতে আরো ৪-৫ ঘণ্টা কম করে।
বন্ধুর বাবা বললো, এখানে কাছে রেল স্টেশন আছে সেখান থেকে বিকেল ৬টা র লোকাল ধরে সরোজিনী নগর যেতে পারবে। সেখান থেকে তো বাড়ি কাছে, মানে এই তিন কিলোমিটার হবে আর কি.
কথা টা ঠিক, সেই মত ৫:৪০ এ তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশন। ট্রেন এসে গেলো, ভীড় ছিল, যা দিল্লীর লোকালে থাকেনা। কারণ একটি, আমার মত আটকে যাওয়া মানুষের ভীড়।
ট্রেন চর্চায় মুখর। কারা দাঙ্গা করছে, কত মানুষ, কত ঘর বাড়ি, সবার অনুমান আর মন্তব্য। আর লাইনের পাশে যে দৃশ্য দেখেছি সেই সন্ধ্যে বেলা, ১৯৮৪ থেকে ২০২৪, ৪০ বছরেও তার ছায়া যেনো ভাসে চোখের সামনে।
১২ কিলোমিটার হেঁটে দুটো বাড়ি তে আগুন দেখেছিলাম। ভাঙ্গা গাড়ি দুটো। কিন্তু ট্রেন যখন দিল্লির প্রায় পুরো চক্কর লাগিয়ে যাচ্ছে, দু দিকে আকাশে ধোঁয়া উড়ছে। এক জায়গায় লাইনের পাশে প্রায় দুতলা সমান উঁচু জমি আর তার ওপর ফ্ল্যাট এর সারি। হঠাৎ নজরে এলো, লাইনের ধারে এক জন মানুষ, সর্দার, পড়ে আছে। পরিষ্কার দেখলাম তার হাত টা কনুই থেকে পেছনে মুড়ে ভেঙে দিয়েছে কেউ, পা হাঁটু থেকে পাশে ঘুরে গেছে। সে তখনও বেঁচে, ক্ষীণ চিৎকার টা চলতি ট্রেন এর ভেতরে ও শোনা গেলো, বাঁচাও, কেউ বাঁচাও।
একটু পরে একটি পুল এর তলা দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে, আমাদের সামনেই ওপরে একদল লোক একটা স্কুটার নিচে ফেলে দিল। ঠিক পরেই একজন মানুষকে। স্কুটার এ আগুন ধরে গেল, মানুষ টা কে সেই আগুনেই নিক্ষেপ করল। অমানুষিক ভীড় কেনো করছে, কারা করছে, কিছু জানিনা। ট্রেন যাত্রীরা সবাই উত্তেজিত, অনেকের নিজের মত, আর মতভেদ। আবার সবার চিন্তা, ট্রেন থেকে নেমে কোথায় কি করে যাবে ।
শাদি পুর, কিষণ গঞ্জ, সদর বাজার, কম করে আট দশ জন দেখলাম। জীবিত না মৃত সেটা সবার বুঝলাম না। নতুন দিল্লী স্টেশন এর পর আর এ দৃশ্য দেখা গেলো না। তবে দু পাশে বাড়ি ঘর এর আগুন ও ধোঁয়া সারা রাস্তা দেখলাম।
বিস্মিত, চিন্তিত, আমি সরোজিনী নগর এ নেমে তিনকিলোমিটার হেঁটে বাড়ি গেলাম। ততক্ষনে বাড়ির সবাই যেনো কাঁটার ওপর চলা ফেরা করছিল। আমি ছাড়া সবাই বাড়ি এসে গেছে। বাড়ি তে দুটি সর্দার পরিবার কে এর মধ্যে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে দেখলাম। দুটো ঘরের বাড়ি তে আমরা ১০ জন থাকতাম। সবাই একটা ঘরে এর ওর ঘাড়ে পা তুলে সোয়া বসা চললো কদিন।
দুটো পরিবারের ৬-৭ জন অন্য ঘরে রইলো। ৪ দিন পর যখন আর্মী এলো তখন ওরা চলে গেলো অন্য কারো বাড়ি। এর ভেতর ওদের বাড়ি তেও আগুন লাগিয়ে বাড়ির সব জিনিষ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
সেদিনের সেই লাস্ট লোকাল আমার মত অনেক কেই বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু ওই রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের পাশে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। আমরাও না। কি দোষ ছিল ওদের? এটা কিরকম মাকড়শা আর কীরকম অভিশপ্ত জাল এ আমরা মানুষেরা আটকে গিয়েছিলাম? আমরা কি আদৌ সেই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করি?
অনুপ মুখার্জি "সাগর"
betpark
ReplyDeletetipobet
betmatik
mobil ödeme bahis
poker siteleri
kralbet
slot siteleri
kibris bahis siteleri
bonus veren siteler
BOSS