কাঁঠালের আমসত্ত্ব
আমরা কি ধান গাছের তক্তা দিয়ে বানানো তক্তপোষে আকন্দ গাছের ছায়ায় বসে সোনার পাথর বাটি তে কাঁঠালের আম সত্ত খেতে খুব ভালো বাসি আর কিছু মানুষ সেটাই খাইয়ে খাইয়ে আমাদের বোঝাতে থাকে যে আমাদের পেট ভরা আছে।
'মুখার্জি সাহেব নমস্কার, কত দিন পর আপনার সাথে দেখা, আসতে পারি ভেতরে।'
রবীন্দ্র মুখার্জী সচিবালয় থেকে অবসর প্রাপ্তির পর বিশ্রাম নেবার জন্য বেশ কিছু দিন দেশে গ্রামে ঘুরে ফেরত নিজের কলকাতার ফ্লাট এ এসেছেন এই এক সপ্তাহ। পুরানো অনেকেই ওনার খোঁজ করছিলো, তাই মাঝে এক দিন অফিস হয় সবার সাথে দেখা করে এসেছেন। পি এফ ইত্যাদি সব হয়ে গিয়েছিলো বলে তেমন কোনো টেনশান নাই , শুধু মেডিক্যাল এর কার্ড তা বাকি ছিল। সেটা সেদিন অফিস গিয়ে জানলেন ১০-১৫ দিন এ এসে যাবে।
সেদিন অফিসে এই প্রতাপ গুপ্তর সাথে দেখা হয়েছিল। প্রতাপ অফিসের সবার ট্যাক্স সেভিং এর কাজ আর জীবন বীমা ইত্যাদি করতো। সে বলেছিলো দেখা করতে আসবে, আর সেই প্রতাপ এর পদার্পন।
রবীন্দ্র বাবু যত দিন চাকরি করেছেন, অনেক বেশি কিছু করতে পারেননি, অনেক বার নিজের বিবেক মতো কাজ করে গিয়ে সাজা পেয়েছেন, খারাপ ট্রান্সফার এর মাধ্যমএ। ঘুষ এর রাজ্যে মোটামুটি একা পড়ে থেকেছেন। মনে কোনো ব্যথা ছিল না তার কারণ যারা অনেক বেশি এগিয়ে গেছে ওনাকে আর্থিক দিক দিয়ে পেছনে ফেলে, তাদের ভেতর কারুকে আবার মুখ থুবড়ে পড়তেও দেখেছেন, আত্ম হত্যা করতেও দেখেছেন এক জন কে।
এই প্রতাপ আবার, সোনা কথা যদিও, অনেক সময় দালাল এর কাজ করতো অফিসে। কেউ যদি ঘুষ নিতে ভয় পেয়েছে তো প্রতাপ সাহায্য করেছে, দুধের সর টি নিজের কাছে রাখিয়া, ঘোল তে ভাগাভাগি করার কাজ তা প্রতাপ করতো। কিছু অফিসের দেড় ফালতু আয়ের টাকাও নাকি প্রতাপ ম্যানেজ করতো, নাম বেনাম এর বেবস্থা প্রতাপ এর থাকতো।
সেই প্রতাপ এসে সকাল বেলা রবীন্দ্র বাবুর বাড়ি হাজির। যথা রীতি কাজের মাসি চা জল খাবার নিয়ে এলো আর দুজনে মিলে খেতে খেতে কথা আরম্ভ হলো।
'রবি বাবু,, আমি এসেছি আপনার কাছে একটা ভালো প্রপোজাল নিয়ে। আপনি নিজের গ্রাচুইটি, পি এফ ইত্যাদি তে বেশ ভালো টাকা পেয়েছেন, আপনার বাড়ি আছে নিজের, কলকাতা তেও আছে আর গ্রামের বাড়ি ও তাই বাড়ি করার চিন্তা আপনার নেই। আপনি সব টাকা গুলো যদি ব্যাঙ্ক, পোস্ট আফিস ইত্যাদি তে রাখেন তো বার্ষিক মাত্র শতকরা ৭-৮ টাকা সুদ পাবেন, তাতে কি আর সংসার চলবে দাদা। '
যে এতো দিন শুধু স্যার বলতো, আজ হঠাৎ 'দাদা'! তা রবি বাবু ভাবলেন, যদি তো গেছে, আর স্যার থেকে হবেই বা কি। বললেন, 'প্রতাপ বাবু, আমি নিজের ক্ষিদে নিজে ম্যানেজ করতে শিখেছি, তাই যা শতকরা ৭-৮ শতাংশ সুদ পাবো, তার সাথে পেনসান , আমার জীবন চলে যাবে। সে নিয়েই আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি তো কি সব চীট ফান্ড করতেন, সে গুলো তো এখন সব চিৎপটাং হয়ে গেছে। তা সেরকম যদি কিছু থাকে তো সেটা আমাকে দয়া করে শোনাবেন না। '
'আরে না না দাদা, আপনাকে আমি সে সব রাস্তায় ডাকার চিন্তা ও করবো না। আপনি তো শেয়ার বাজার এ ও টাকা লাগান নি কখনো যখন কি আপনার জুনিয়ার ঘোষ তো গত পাঁচ বছরে কম করে ৪-৫ লক্ষ রোজগার করেছে। '
'দেখুন প্রতাপ বাবু, কে কত রোজগার করছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার জ্ঞানত তো ঘোষ বাবু গত বছরে খুব কান্না কাটি করছিলেন, ওনার না কি ৮ লক্ষ্য লোকসান হয়েছিল!'
'শুনুন রবি বাবু, শেয়ার বাজার তো খেলার জায়গা না। গত বছরে উনি হঠাৎ অন্য কারুর কথা শুনে টাকা লাগিয়ে ছিলেন, তাই লোকসান হলো। আমি কথা দিয়েছি ওনার লোকসান পুরো করে দেখাবো। '
'তা বেশ ভালো। তবে আপনি আমার জন্য কি বলছেন। '
'রবি দা, আপনি তো জানেন ভারত সরকার আর অনেক রাজ্য সরকার এখন হর্টিকালচার এ খুব জোর দিচ্ছে। কেরালা কর্ণাটক এ বিঘের পর বিঘে জমি সরকার দিচ্ছে গাছ লাগাবার জন্য। আমার এক বন্ধু ওখানে ১০০০ বিঘে জমি কিনেছে। তাতে ও টিক আর রাবার এর গাছ লাগিয়েছে, হোটেল রিসোর্ট বানিয়েছে। এখন ও গ্যারান্টী স্কিম দিয়ে আগে গাছ সহ জমি বিক্রি করছে। ও সরকার থেকে জমি কিনে প্রায় ৩০০ কোটি খরচ করেছে। এখন ও শেয়ার দিতে চায়। ১০০ ফুট করে জমি যাতে ১০ টা করে গাছ আছে ও বিক্রি করছে মাত্র ৫০,০০০ টাকায়। আজকের দিনে একটা ২০ বছর পুরানো গাছের দাম হলো ১০ লক্ষ। মনে করে দেখুন, এ গাছ ২০ বছর পর তো কম করে এক কোটি টাকার হবে। আপনি আজ ৫০,০০০ লাগান, ২০ বছর পর এক কোটি। আমি তো বলবো, আপনি ৪-৫ লক্ষ টাকা লাগিয়ে দিন, চিন্তা করেন, যখন আপনার বয়স ৮০, তখন আপনার টাকার দরকার ও বেশি হবে, আর আপনার আজকের ৪ লক্ষ্য সেদিন আপনাকে ৮ কোটি টাকা দেবে। কাগজ সব ঠিক আছে, রেজিস্ট্রি আপনার নাম এ হবে। আপনি চাইলে সেখানে গিয়েই নিজের বেড়া ও লাগাতে পারেন। এই ২০ বছর ধরে গাছ এর দেখা সোনা সব আমার বন্ধু করবে। দেখা সোনার জন্য এমনি তে ও টাকা নিচ্ছে কিন্তু আমি মাঝখানে আছি বলে ও সেটাও ছেড়ে দেবে। আমি ফর্ম এনেছি, আপনি বাস্ সই করে চেক তা দিয়ে দিন, ১৫ দিন এর ভেতর আপনার কাছে জমির কাগজ এসে যাবে। '
'প্রতাপ বাবু, রঘুরাম রাজন কে চেনেন ?'
'হাঁ , তা ওনাকে কে চিনবে না? কেন বলুন তো। '
'বাংলায় একটা কথা আছে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর ওই রঘুরাম রাজন কে বাঙালির চিট ফান্ড এর টাকা চুরির পর কেউ জিগেস করে ছিল, এ চুরি রিসার্ভ ব্যাঙ্ক রুখতে পারে না কেন ? তখন উনি জবাব দিয়েছিলেন যে যত দিন মানুষের লোভ এর সীমাহীন থাকবে, এ চুরিও থাকবে। যেখানে ব্যাঙ্ক ৭-৮ হারে সুদ দিচ্ছে, কোম্পানি রা কেউ ১২ আবার কেউ হয়তো ১৮ টাকা হারে, সেখানে হঠাৎ কেউ এসে বলবে মাসে ১০-২০ শতাংশ সুদ দেবে আর আমরা তার পেছনে টাকা লাগাবো, তা সে টাকা তো মারাই যাবে। তা প্রতাপ বাবু, আপনার বন্ধু, বন্ধুত্ব এবং আপনাদের ব্যবসার ওপর আমার কোনো মন্তব্য করার মানে হয়ে না। তবে, নিজের ব্যাপারে শুধু একটাই জিনিস বলতে পারি, আপনার এই সুন্দর ব্যবসার প্রপোজাল টা আমার শুধু একটি জাল মনে হচ্ছে। এটা যেন ওই কাঁঠালের আমসত্ত্ববৎ আমার গলায় আটকাচ্ছে। আমি এটা খাবার চেষ্টা করার কোনো উৎসাহ পাচ্ছি না। নমস্কার। আপনি এবার আসুন। "
দাদা বেশ ভাল লিখেছেন । কথা টা একদন সত্যি, যতক্ষণ আমরা লোভ সামলাতে পারবনা ততক্ষণ আমাদের এই ভাবেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বিক্রি করে খাওয়াতে থাকবে কিছু মানুষ, জারা হয়তো অমানুষ
ReplyDeleteএকদম ঠিক। কত এই রকম স্ক্যাম হয়েছ। সব লোভে।
ReplyDelete