বিশেষ বিকেলের আলাপ
এই তো সেদিন, ওই বড় মাঠ টা তে বেড়াতে গেলাম। বেশ অনেক টা হাঁটলাম, মানুষ জন কে দীঘি তে নৌকা বিহার করতে দেখলাম। দেখলাম কিশোর বয়েসের ছেলে মেয়েরা বেশ হাঁসি মুখে ঘুরছে, কেউ বড় দলে, আবার কেউ বা একাকী। খানিক ঘুরে একটি বেঞ্চি তে বসলাম। কিছু টা সময়ের পর পিঠে হাত রেখে পাশে এসে বসলো আদিত্য।
কিরে, কেমন আছিস? একা একা বসে কী করছিস?
আয় বোস, ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, তাই একটু বিশ্রাম করছি।
আচ্ছা, আমি তো ভাবলাম শুধু বিশ্রাম করছিস।
তাই আর কি, আজ কাল আর কাজ কি, বিশ্রাম ছাড়া? ব্যাস, এখনও অফিস এ চলে যাই সপ্তাহে চার পাঁচ দিন, আর রোজ হেঁটে নিচ্ছি।
সত্যি রে, কত বেষ্টনী তে জীবন কে আবদ্ধ করে রাখি, হঠাৎ দেখি জীবন টাই ফাউ হয়ে গেলো। কত শত বিকেল কেটে গেছে, এই আজকাল কত সময় নিজেদের বহে যাওয়া সময়ের দিকে তাকাই।
সেটা অবশ্য ঠিক, তা আমাকে বল এখন কোন বিকেলের কথা বেশি করে মনে পড়ছে।
আমার তো রাজেশ খান্না আর ওয়াহিদা র বিকেল টা মনে পড়ে, ও শাম কুছ আজিব থী। আর মনে পড়ে সন্ধ্যার একটু পর চৌরঙ্গী তে দুটি গান, কাছে রবে, বিশ্বজিৎ আর বড় একা লাগে, উত্তম কুমার।
বাহ্, ভেতর টা দুলে উঠলো গান গুলো মনে করে। তবে এগুলো আমরাও বিকেল এর শো তেই দেখেছি, তাই সেই বিকেল গুলো তো আমাদের ও বটে।
দুজনে একটু মন খুলে হেঁসে নিল।
তা ঠিক কথা বলেছিস। ওয়াহিদা ও ছিল বটে, আমার কাকার ও পছন্দ, আমার ও।
শুধু ওয়াহিদা কেনো রে, দেবানন্দ ও তাই।
একদম ঠিক। আচ্ছা তোর কোন বিকেল মনে পড়ে?
আমার ও তো গান মনে পড়ছে, যদিও গান টা অনিন্দিতা সিনেমা তেও ছিল, দিনের শেষে ঘুমের দেশে। আর মনে পড়ে কিশোরের গাওয়া এক দিন আরো গেলো, থামানো আর গেলো না।
রবি ঠাকুরের গানের কথা অনবদ্য, কি লিখেছে, ফুলের বাহার নাইকো যাঁহার, ফসল যাঁহার ফললো না, অশ্রু যাঁহার ফেলতে হাঁসি পায় ...
যা বলেছিস, দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁঝের আলো জ্বললো না...
আরে শোন, গান সিনেমা ছাড়, নিজের কথা বল, তোর কোনো বিকেলের কথা মনে পড়ে?
মনে পড়ে, হয়তো কিছু না, হয়তো অনেক কিছু। ব্যাস, বসেই ছিলাম, শুধু চুপ, চুপ ছিলাম, চিন্তাও দিশা হীন, দৃষ্টি ও দিশা হীন। না কোনো কাজের তাড়া, না সময়ের প্রশ্ন। না চোখে কিছু ধরা পড়ছে, না কানে কোনো শব্দ ঢুকছে। সূর্য অস্ত গিয়ে আকাশের নীলিমা নিজেকে কালো আঁধারের হাতে তুলে দিচ্ছে রোজ কার নিয়ম অনুযায়ী।
বন্ধু, আমরা জীবনের যে বিকেলে আছি, সেটার পর তো রাত, কোনো সকাল তো আসবেনা। তার ওপর আবার এই ছোট্ট একটি দিনের একটি ক্ষুদ্র বিকেল টা কে নিজের ওপর কেনো চাপাতে দেবো।
সেটা তুই ঠিক বলছিস, জীবন তো মহাসমুদ্র, আর তার প্রতিটা মুহূর্ত হলো সেই অসীম সাগরের ঢেউ। আর কোনো ঢেউ জানেনা সে কখন অন্য আরেকটা ঢেউয়ের মধ্যে মিশে যাবে, নাকি সৈকত এ আছড়ে পড়ে বালির ভেতর মিশে যাবে। যখন জানা নেই যে কোন মুহূর্ত শেষ ঢেউ আসবে, তখন তার অপেক্ষায় না থেকে প্রতি টা মুহূর্ত কে বেঁচে নেওয়া যাক, যেনো ঢেউ গুলো দোলনায় দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
বাহ্, তুই তো সাহিত্য রচনা করে দিলি।
ভূমিকা তো তুই লিখলি।
আসলে আমরা নেশা গ্রস্ত, এক এর পর এক নেশা, কিছু করার, না করার, কারো কে খুশি করার, নিজের ইচ্ছে, অন্যের ইচ্ছে, এ সবের ভেতর না তো নিজেকে চিনলাম, না কিছু। তবে নেশার কথাই উঠলো, তুই তো আজব একজন। সবাই মদ এর নেশা করে অল্প বয়সে, ৪৫-৫০ এ এসে ছেড়ে দেয়, আর তুই ধরলি ছাড়ার বয়সে।
ভাই রে, আমার জীবন তো খোলা বই তোর কাছে। লোকে দুঃখ ভোলার জন্য, আনন্দ করার জন্য খায়। আমি তো জানিস তখন খেলাম যখন মনে হলো জীবন টাই ভেঙে গেলো। চল, আজ আমরা অনেক দিন পর বসে গল্পঃ করলাম, আজ একটু বসে দু পেগ খাওয়া যাক।
তুই আবার খাবি, যত কথা বলিস নেশা করার, তার এক শতাংশ ও খাসনা সেটা আমি জানি।
দেখ, খেয়ে নেশা করার দরকার বেশি নেই। আমরা সবাই তো নেশা গ্রস্ত। কেউ অধিকার এর নেশা, কেউ কর্তব্যের নেশা, কেউ যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দে মেতে আছে, কেউ যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে অসার অসাড় হয়ে ভাবছে, এটাই শেষ। কেউ জীবনের নেশায়, কেউ মৃত্যুর অপেক্ষার নেশায়।
ইয়ার, আমরা বসলাম কোনো বিকেলের সুন্দর স্মৃতি মন্থন করার জন্য, আর কোথায় পৌঁছে গেলাম। আমার তো মনে হয় এখন সব থেকে সুন্দর নেশা হলো একাকী থাকার নেশা। নেশা, যেখানে নিজেই নিজের বন্ধু, সহযাত্রী, কোনো দ্বন্দ্ব নেই, মান অপমান এর মাপকাঠি নেই, শুধু আমি, আর আমি।
সেটাই সব থেকে বড়, সেটাতে যখন আমরা খুশি হই, তখন আর আমাদের অন্য কোনো খুশি করার সরঞ্জাম দরকার পড়ে না।
আচ্ছা, এবার একটু আসে পাশে খেয়াল কর, মশাগ্রম এর মশা রা সব দল বেঁধে আসতে আরম্ভ করেছে, তাদের জন্য রক্তদান শিবির লাগিয়ে তো কাজ নেই। ওঠ, একটা চক্কর দিয়ে বাড়ি যাওয়া যাক।
হ্যাঁ, ওঠা যাক, চল যাওয়া যাক। আজকের বিকেলের কাহিনী আজকের মত শেষ।
অনুপ মুখার্জী "সাগর"
বাহ্ সুন্দর
ReplyDelete