যাত্রা তে রোমাঞ্চ আছে নিঃসন্দেহ। আছে অজানা কে চেনার, জানার সুযোগ সুবিধা, আনন্দ আর মিশ্রিত অনুভূতি, আর আছে শিক্ষার সুযোগ। শর্ত শুধু একটাই, মন, মাথা, কান খোলা,আর অজানা কে জানার ইচ্ছা রাখা। যদিও আজকের পরিস্থিতি তে সাবধান থাকার ব্যাপার টা কোনো মতেই এড়ানো যায়না। তাহলেই আমরা একদম হরির লুটের মতন করে চেনা, জানা আর স্বল্প খুশি লুটে নিতে পারি।
১৯৮০র দশক এর মাঝামাঝি। লেখা পড়া শেষ করে কাজ কর্ম শুরু করেছি, ট্রেন করে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া অনেক টা বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণত কাজ ছাড়া বেরুতাম না আর কাজের কারণেই এত বেরুনো হতো যে ছুটি নিয়ে ঘোরার ইচ্ছে করতো না। সেই রকম এক সময়, কোনো কারণে মন মাথা খুব খারাপ। সেটা বাড়ি তেও সবাই বুঝতে পারছিল। তো বোধ হয়ে প্রথম বারের মত ১৫ দিন ছুটি নিয়ে ডিলাক্স (এখন কার পূর্বা) তে চড়ে দিল্লী থেকে কলকাতা পাড়ি দিলাম।
সাইড এর নিচের সীট আমার, ওপরের টা তে এক মহিলা এলেন, মনে হল সমবয়সী । সাথে কোলের সন্তান। বর ছাড়তে এসে ছিল, বোধহয় বাড়ি তে কোন কিছু ঘটেছে তাই যেতে হচ্ছে। যে ছাড়তে এসেছিল সে বলল, "একটু দেখবেন, বাচ্ছা নিয়ে যাচ্ছে, আমি ছুটি পেলাম না। কী করি, গত মাসেই আমরা এসেছি, এখন ওকে যেতে হচ্ছে।"
আমিও বললাম, "চিন্তা করবেন না, হাওড়া যাবেন তো কোন চিন্তা নেই। রাস্তায় কিছু অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন। যা পারি করব।"
ছেলে টি বলল, "হাওড়া তে ওঁর কাকা নিতে আসবেন।"
তখন মোবাইল ফোন বা জলের বোতল কোনো টাই দেখা যেত না। ট্রেনে আমরা স্টেশন এ জল ভরে নিতাম নিজেদের বোতলে। টুন্ডলা পর্যন্ত আমাদের আলাপ হয়ে গেল ভালই। মেয়েটি আমার থেকে দু বছর ছোট। দাদা ছিল, প্রায় দশ বছর আগে পুকুরে ডুবে মারা গেছে, তাকে আমার মত দেখতে ছিল, আর তার নাম ও ছিল সাগর। তার বাপের বাড়ী ও মুখার্জি।
সে প্রশ্ন করলো, আর আমিও রাজী হয়ে গেলাম, আমাকে দাদা বলে সম্বোধন করবে আর আমি সেই নামে সম্বোধন করবো যে নাম এ ওর দাদা ডাকতো। ওর নাম অপর্ণা, সবাই ডাকে অপু, কিন্তু ওর দাদা ডাকত অনু।
রাত ৯টা নাগাদ বললো, "দাদা, আমি কিন্তু নিচে শোবো, এটা বোনের আবদার। তুমি কি চাদর এনেছ বার করে দাও। আর খাবার কিছু এনেছো না এমনি বেরিয়ে এসেছো? না এনে থাকো তো আমরা ভাই বোন মিলে খেয়ে নেবো।"
খোলা জানালা দিয়ে এক ঝাঁক হালকা ব্যাথা আর এক ঝাঁক ভালো লাগার হাওয়া বয়ে গেলো। আমি তো বাড়ি থেকে ভোর বেলা নিজের জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। দুপুরে অফিস এ খেয়ে নিয়েছিলাম, রাত এ খাবার কোনো ইচ্ছা রাখার ছিল না। আর চাদর নিয়ে ট্রেন চড়ার কথা শুধু শীত কালে ভাবতাম। খাবার আনিও নি, কেনার ও ইচ্ছে হয় নি।
"না রে বোন, আমি চাদর টাদর নিয়ে বেরুই না, আর ট্রেন ধরার আগে অনেক টা খেয়েছি তাই আর খাবার কোনো ইচ্ছে নেই। তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি কানপুর এ জল ভরে রাখবো, তার পর শোবো। ওপরে চড়ে ততক্ষন পিঠ টা ছড়িয়ে নিচ্ছি।"
কোলের ছোট মেয়েটি সবে এক বছরের হয়ে নি। তার আর নিজের খাবার অনু নিয়ে এসেছিল। ফ্লাস্ক এ গরম জল এনেছিল, বাচ্ছার দূধ বা খাবার বানাবার। সেটা খালি হলে পান্ট্রি থেকে ভরা হবে।
"তোমায় ওপরে এখন যেতে হবে না। আমি তুষ্টি কে খাইয়ে দি, তার পর যেও। ততক্ষন নিজের বই পড়ো।" আমার হাতে তখন জলধর সেন এর লেখা 'পদ ব্রজে ' ।
অনুর তুষ্টি তো খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। খুব শান্ত, একটুও কাঁদে নি। মনে হলো ওর মার চেহারায় যে শান্ত কমনীয়তা আছে সেটা সন্তানের চরিত্রে এসে গেছে।
এবার আমার নতুন পাওয়া বোন নিজের ব্যাগ থেকে দুটো চাদর বার করলো, "একটা আমি নেবো, একটা তুমি। দুটো এনেছি যদি ঠান্ডা ভাব থাকে, যেটা নেই একদম।" আমার কোনো আপত্তি টিকলো না। নিজে ওপরে উঠে চাদর পেতে দিল। তারপর খাবার বার করলো। যা ছিল দুজন কে খেতে হলো। তিন বেলার খাবার এনেছিল, দু বেলার খাবার আমরা শেষ করে দিলাম। মাঝে আমি নেমে জল নিয়ে এলাম।
অনু নিজের ছোট তুষ্টি কে নিয়ে শুয়ে পড়লো, আমি ওপরে। ট্রেন এ সাধারণত অনেক ঘুমোই কিন্তু সেদিন ঘুম আসতে দেরি হলো। যেখানে নিজের আত্মীয় বন্ধু দের সঙ্গে প্রচুর মত ভেদ, সেখানে হঠাৎ করে এক অচেনা অজানা কি করে এমন ভাবে দাদা বানিয়ে ফেলল। নিজের কত কিছু গল্পঃ করে নিল, আমার ও কিছু শুনে নিল, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
কোন সময় ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘুম ভাঙ্গলো এই বোনের ডাকা ডাকি তে। "উফফ, তোমরা কি করে এত ঝাকানি তে ঘুমও, ওই দাদা টাও ট্রেন এ যেনো বেহুঁশ হয়ে ঘুমাতো। এবার ওঠো, ফ্লাস্ক এ চা নিয়েছি, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।"
উঠে চা আর বিস্কুট খেলাম, ওই একটা জিনিস নিয়ে বেরুতাম। আমার বিস্কুট থেকে কটা তুষ্টির হাতে দিলাম, ও বেশ ইঁদুর এর মত ধীরে ধীরে খেতে থাকলো। কিছু খাবার আমি কিনলাম আর ওর কাছে যা ছিল দুজনে মিলে দিন টা কেটে গেলো। এর ভেতর ওর মৃত দাদার পুরো কাহিনী শুনলাম। হাওড়া আসার আগে আমার কলকাতার ঠিকানা আর সম্ভাব্য টেলিফোন নম্বর দিলাম আর ওর নম্বর আর ঠিকানা ও নিলাম।
যে অফিসের ফোন দিয়েছিলাম সেখানে দুদিন পর গেলাম। গিয়েই শুনি কম করে ৬/৮ বার ফোন এসেছে, পরিচয় আমার বোন। আমি ফেরত ফোন করলাম।
"আরে সাগর, তুমি কি করেছ, আমি অপুর মা বলছি। অপু নিজের বাবার শরীর খারাপ শুনে এসেছে। ওর বাবা এখন ঠিক আছে, তবে অপু তোমার ফোন না পেয়ে দিশাহারা হয়ে গেছে। এখন একটু বাজারে গেছে, ও তোমাকে ফোন দেবে এক ঘন্টা পর। তুমি অফিস এই থেকো।"
"আচ্ছা মাসিমা, আসলে আমি তো অফিসের কাজে আসিনি, তাই আর কি। ছুটির আমেজ এ ছিলাম। আমি এখানে আছি বিকেল পর্যন্ত। অনু কে বলবেন ফোন করতে।"
ফোন এ কথা হলো। নাছোড়বান্দা একদম, " না দাদা, তুমি বলেছ তোমরা ১৫ দিনের টিকিট আর শুধু ৮ দিন ঠিক করে রেখেছ কার কার বাড়ি যাবে। বাকি সময় টা এই বোনের বাড়ি কাটাতে হবে।"
মনে সংকোচ ছিল, হ্যাঁ বলার সাহস পেলাম না। "না রে, এক দিন দেখা করতে আসবো না হয়, থাকা হবে না।" কিন্তু এই অনুর আবদার এর সামনে আমার সংকোচ টিকলো না। ওর মা বাবা ও ফোন ধরলো, তোমাকে আসতে হবে বাবা, থাকতে হবে। "দেখো তুমি শহরের মানুষ। আমরা গ্রামের চাষা ভুষো লোক, নিজেদের যা সাধ্য তার চেয়ে বেশি খেয়াল নিশ্চই রাখবো। আমাদের সাধ্যের সীমা থাকতে পারে, আন্তরিকতার কিন্তু কোনো সীমা নেই বাবা। যদি মনে করো তোমার অসুবিধা খুব হবে তাহলে জোর করবো না।"
শেষ দুটি দিন এর জন্য গেলাম। শনিবার বিকেলে কালকা মেল ধরার ছিল, আমি ওদের গ্রাম এ বৃহস্পতি বার সন্ধ্যে বেলা গেলাম। দু রাত থেকে শনিবার সোজা হাওড়া যাবো গাড়ি ধরতে। সেদিন কেই রাতে খাওয়া দাওয়ার আগে পুরো বাড়ি দেখলাম। অনুর দাদার প্রতি টা জিনিস দেখলাম। আশ্চর্য হলাম, ওর প্রায় সব কিছু, সব পছন্দ আমার সঙ্গে অদ্ভুত মিল। ওর সব জিনিস, জামা কাপড়, যেনো আমার, যেন আমার জমজ ভাই ছিল। ফটো তেও অদ্ভুত মিল। আমাকে দেখে ওর বাবা মা নিজের কান্না আটকাতে পারেন নি, কিন্তু অনুর একটাই কথা, দাদা ফিরে এসেছে।
দু দিন যে কি ভাবে কাটলো জানিনা। প্রতি টা আত্মীয়র সঙ্গে পরিচয় হলো।
আমি চলে এলাম দিল্লী। অনু এসে গেলো প্রায় আরো এক সপ্তাহ পর। ওর দিল্লীর বাসা অনেক টা দুর, কিন্তু আমি গেলাম দেখা করতে। শুধু একবার না, পরের দু বছরে বেশ কয়েক বার। দুর্গা পুজো কালি পুজো তে অনু দেশের বাড়ি যেত, ভাই ফোঁটা তে যেতে বলতো, তবে যাওয়া হয়ে নি। রাখী তে যেতাম। পুজোর আগে বোন ভগ্নিপতি কে জামা কাপড় কিনে নেবার জন্য টাকা দিতে গেলাম, "না দাদা, টাকা নেব না। তুমি আর আমি বাজার যাবো, এক সঙ্গে কিনবো।"
ও কিছু তেই নিজের পছন্দ বলবে না, আমার পছন্দ মতো জামা কিনতো, আর পুজোর প্রথম দিনেই আমার দেওয়া জামা টা পরতো, ফটো তুলে রাখতো, ফোনে বলতো, দাদা, তোমার দেওয়া জামা টা পরেছি । আমার জন্য অনু জামা কিনে দিতে, আবদার করতো, প্রথমে ওর কেনা জামা পরে ফটো তুলে রাখতে হবে। পরে ডিজিটাল ক্যামেরা আর মোবাইল এর আগমনের পর ফটো পাঠানো জরুরি ছিল।
ওর বরের সঙ্গেও ভালো আলাপ হয়ে ছিল। সে বলতো, "আপনার বোনের জীবনে দাদার যাবার ক্ষতি টা আপনি পুরো করে দিয়েছেন, অনেক ধন্যবাদ।"
৮ বছরের মাথায় ওরা দেশের বাইরে চলে যায়, তার পর ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে যায়। দেশে ওরা আর ফিরে আসেনি। এই ৮ বছরে অনুর মা বাবা মারা যান। বরের মা বাবা আগেই ছিলেন না।অনেক টা সময় কেটে গেছে, কিন্তু সেই ভাই বোনের ভালো লাগার স্মৃতি কোনো দিন ভোলার না। যোগাযোগ এখনো আছে, কথা এখনো হয়ে।
ট্রেন যাত্রা যেটা শুরু হয়েছিল এরকম এক বিরক্তি ভরা মানসিক অবস্থা নিয়ে, সেটা যে এরকম মধুর সুগন্ধ দিয়ে যাবে সারা জীবনের সেটা ত জানতাম না।
এ সম্পর্ক টা খুব বেশি মানুষ জানেনা, কারণ যে সমাজ সহোদর ভাই বোন এর ভালোবাসা সহ্য করতে পারেনা, তারা এ সম্পর্ক বুঝবে না, মানবে না, জানবে না।
আজ লিখলাম, সবার জন্য। পরিচয় সব গোপন রইলো।
অনুপ মুখার্জী, "সাগর"
খুব সুন্দর আর প্রাণে লাগার মতো গল্পও। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে ভাই বোনের সুন্দর একটা সম্পর্ক হতে পারে ,খুব সুন্দর করে লিখেছো।
ReplyDeleteKhub simple storyline but emotionally touches one's heart
ReplyDelete