প্রথম শ্মশান যাত্রা
এটা মোটামুটি সেই সময়ের ঘটনা হবে যখন আমি ১৫ বা ১৬ বছর বয়েসের ছিলাম । সেই সময় বন্ধু বান্ধবের সাথে মেতে নিজেদের সর্বজ্ঞ মনে করতে শুরু করে ছিলাম। তথাকথিত বন্ধু দের নিজের থেকে উনিস প্রমাণ করার একটা প্রতিযোগিতা তে মেতে থাকতাম অনেকেই। সবাই ভাবতাম, আমরা যা জানি, তার বাইরে আর কিছু নেই জানার ।
সেই সময় এক দিন বাবার এক বন্ধু, দত্ত কাকু মারা যান কোন এক কারনে। আমি ওনাকে ছোট বেলা থেকে চিনতাম, প্রায় বাবার সঙ্গে আমাদের বাড়ি আসতেন আর আমার জন্য টফি ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। আবার একটু বড় হতে কখনো পেন, কখনো বই ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। ওনার বাড়ির অন্য কারো সাথে পরিচয় হয়ে নি।
বাবা ডেকে বলল, 'দত্ত কাকু আজ চলে গেছেন, তোকে খুব পছন্দ করতেন, প্রায় তোর কথা জিগ্যেস করতেন। আমার সাথে চল, ওনাকে শেষ বিদায় টা জানিয়ে আয়'। তার আগে কখনো শ্মশানে জাইনি,মনে একটু সংশয়, একটু ভয় ছিল। সে সব সাথে নিয়ে বাবার সাথে গেলাম। যখন পৌঁছুলাম তখন দত্ত কাকু কে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাকে কে একজন কিছু ফুল দিল, বলল, ওনাকে প্রণাম কর। আমি ওনার পায়ের কাছে ফুল রেখে প্রণাম করলাম। চোখ ছলছল করছিল আমার, একেবারে ছোট বেলা থেকে যাকে দেখে আসছি, সে হঠাৎ চলে যাবে, আর তার দেহ টাই আমার প্রথম দেখা মৃত দেহ। একটু পর অনেকে ধরাধরি করে ওনাকে চিতায় রেখে দিল, আমি দূরে বসে ছিলাম। বাবা এক বার এসে বলে গেল, ভালো করে সব দেখেনে। এটা তোর প্রথম আসা, এর পর অনেক বার আসতে হবে এখানে, কখনো পিছপা হবি না। জানতাম এই উপদেশ টা মা কে উদ্দেশ করে দেওয়া কারণ মা পছন্দ করে না বাবার অনেক কিছু। চিতায় আগুন ধরার পর বাবা আর যারা ছিল সবাই চা খেতে গেল। আমি চা খেতাম না, তো বললাম আমার জন্য লিমকা নিয়ে আসতে।
লম্বা করে বসার জায়গা বানান, সেইখানএ বসে আছি একা একা। হাল্কা ঘুম আসছে, হঠাৎ ডাক শুনলাম, সামনে দত্ত কাকু, "আরে তুই এখানে একা বসে আছিস। বাবার সাথে এসেছিস, খুব ভালো করেছিস। ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুক। এই নে চকলেট খা।" এই বলে আমার হাতে একটা চকলেট দিয়ে চলে গেলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম ওনার যাবার রাস্তায়।
লিমকা নিয়ে বাবা ফিরে এলো। হাতে বোতল দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, হাতে কি ধরে বসে আছিস? আমি বললাম, চকলেট, দত্ত কাকু দিয়ে গেলো! বাবা একদম নির্বিকারে বলল, চকলেট টা খেয়ে লিমকা খেয়ে নে। আরো কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলিস।
আমার হতচকিত অবস্থা, অথবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, যাই বলিনা কেনো। ভাবছি এটা কী, যাকে সবাই চিতায় তুলে দিলো সে আমার হাতে চকলেট ধরিয়ে যাচ্ছে, বাবা বলছে খে নাও। বাবা মাঝে এসে একবার বলে গেলো, খেয়ে নে ওটা, হাতে নিয়ে বসে থাকিস না। আমি দুরু দুরু বক্ষে খেয়ে নিলাম, দেখলাম কিছু হলো না।
বাড়ি এসে মা কে বললাম, ' মা, আমি আর শ্মশানে যাবো না।' মা বলে দিল যেতে হবে না। বিশদ ভাবে কিছু বললাম না, লোকে আমাকে হয়ত পাগল টাগল বলবে। স্কুল এ দু একজন কে বললাম, কথা টা হাওয়ায় উড়ে গেলো।
তিন দিন পরের ঘটনা, পার্ক থেকে ফিরছিলাম খেলা ধুলা করে। বাবা বাড়ি থাকবেনা জানি, কাজে 3 -4 দিনে জন্য বাইরে গেছে। রাস্তা আলো নেই, তবে চাঁদের আলো ভালই ছিল। চাঁদের আলো আর গাছের ছায়া মাঝে আমি নির্বিচারে হেঁটে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা আওয়াজ, 'আরে তুই কোথায় যাচ্ছিস? মাঠ থেকে খেলে ফিরছিস? ' আমার অবস্থা, যেনো কেটে ফেললে এক ফোঁটা রক্ত বেরুবে না। দত্ত কাকু সামনে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব নরম ভাবে বললেন, 'আজকালের ছেলেরা তো এসব জায়গায় যেতে চায়না, তুই এসেছিলি খুব ভালো লেগেছে। তোর বাবা তো এখন বাইরে গেছে, বাবা আসুক তারপর আমাদের বাড়ি আসিস।'
উনি চলে গেলেন না কি হাওয়া তে মিশে গেলেন বুঝতে পারলাম না। তবে আমার নিজেকে ফিরে পেতে কিছু মুহূর্ত লাগলো। তারপর কোনরকমে বাড়ি পৌঁছে প্রথম কথা, আমি আর শ্মশানে যাবনা। তখন দুটোই ঘটনা বললাম মা কে। মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। বাবা কে বলে লাভ নেই, ফোন করলো দিদা, মামা, মাসী ইত্যাদি কে। বেশ কিছু পুরনো কাসুন্দি, কিছু নতুন, বাবার জেদ আর চিন্তা ধারা মা'র আর আমার জীবন দুরূহ করে দিচ্ছে, কথা শোনেনা ইত্যাদি। সে সবের পর এলো উপায়, অমুক মাজার এ ঝাড় ফুঁক, তমুক পীর বাবার মাদুলি, লাল মন্দির এর হলুদ সুতো, ইত্যাদি অনেক কিছু।
দু দিন লাগলো এ সব গহনা জোগাড় করতে। তার পর স্কুল গেলাম। আরো এক দিন পর আবার খেলতে গেলাম বিকেলে। আগের দিনের মতন সময়ে ফিরছি, সেদিন রাস্তায় যথেষ্ট আলো ছিল। সাথেই নতুন গহনা পরে আত্মবিশ্বাস ত একটু বেড়ে ছিল। একটা গাছের ছায়ায় দাড়ানো এক আইস্ক্রীম ওয়ালা থেকে একটা 25 টাকার আইস্ক্রীম কিনলাম। পয়সা দেবো বলে পকেট এ হাত ঢুকিয়েছি হঠাৎ সেই আওয়াজ, আরে তুই সোনা ছেলে, বেশ বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে আইস্ক্রীম খাবি, তা আমিও সাথেই খাই। দত্ত কাকু আরেকটা 25 টাকার আইস্ক্রীম কিনলো, 50 টাকা দিয়ে আমাকে বললো, যা তোর আইস্ক্রীম আজ আমার দিক থেকে। এবার ও বুঝতে পারলাম না, উনি চলে গেলেন না অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন, তবে আমি নিশ্চই হারিয়ে গেলাম। খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির দিকে ছুট দিলাম। বাড়ি পৌঁছে কান্না কাটি, মার রাগা রাগী বাবার ওপর, সব কিছু হলো। ভয় জ্বর ও এসে গেলো।
দু দিন পর বাবা এলো তো মা বাবার ভেতর এক হাত হলো। অবশ্য এটা বলা পুরো ঠিক না কারণ মা বলে গেলো বাবা খানিক শুনলো, খানিক এড়িয়ে গেলো, আর সব কথা শেষ করলো যে কিছু হয়নি, খামোকা ভয় পাচ্ছে। বাবা কোনো দিন বচসায় যেত না, যেটা করার, ঠিক সেটা করতো।
পরের দিন রবিবার, আমাকে বললো, তুই আর আমি বাজার যাবো। বিকেলে বেরিয়ে একটু ঘুরে আমরা খাবার দোকানে বসে সিঙ্গারা আর লস্যি অর্ডার করলাম। খেতে খেতে বাবা বললো," শোন, একটা কথা বলে রাখি, যা আমরা চোখে দেখি আর কানে শুনি সেটা দেখি বা শুনি, কিন্তু সেটা সব সময় সত্যি হয়না। আমরা যা দেখি, শুনি, সোজা বুঝি না, সেটা আমাদের আগের থেকে শোনা জানা কথা যা দেখলাম তার ওপর চাপিয়ে দি, কিন্তু সেটা সত্যি থাকে না, সেটা ঠিক হয়ে না।"
তারপর আমরা গেলাম দত্ত কাকুর বাড়ি। বাবা কড়া নাড়লে কাকুর এক মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। আর দুজনে ভেতরে গেলাম। কাকুর দুই মেয়ে, কাকিমা ঘরে বসে ছিলেন। বাবা আমার পরিচয় দিল কারণ ওনারা কেউ আমাদের বাড়ী আসেনি। ঠিক তখন ভেতর থেকে দত্ত কাকু বেরিয়ে এলো, যা দেখে আমি চমকে দাড়িয়ে উঠলাম। উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বসতে বললেন। বাবা ওনাকে আমার ভয়ের গল্পঃ বললেন। সবার মুখে একবার মুচকি হাসি ঘুরে গেলো। ইনি যে দত্ত কাকুর ভাই সেটা আমি জানতাম না আর তাই ভয় তে আমার অবস্থা খারাপ করছিলাম।
সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবা বলল, আর এক টা কথা বলে রাখি, জীবনে মানুষের ভালো কাজে না যাও কোনো ব্যাপার না, কিন্ত হাসপাতাল আর শ্মশানে যাবার দরকার হলে কখনো মানা করবে না। সেটাই মানুষের মতো কাজ।
10 সেপ্টেম্বর 2020
Comments
Post a Comment