তাস খেলা, ট্রাফিক জাম আর ট্রেন ধরা।
আজ্ঞে, এটাই আজকের গল্পঃ, তাস খেলতে গিয়ে ট্রেন প্রায় ছেড়ে দিল।
বেশ কিছু দিনের কলকাতা যাত্রা। ফেরার টিকিট কালকা মেল যা হাওড়া থেকে সন্ধ্যে ৭টায় ছাড়ে। দক্ষিণ কলকাতার মাঝের হাট স্টেশন থেকে বজবজ লাইন এ তিনটি স্টেশন আক্রা। পিসির বাড়ি থেকে হাওড়া এসে ট্রেন ধরবো।
সেদিন সকালের জলখাবার সেরে সকাল থেকে আমি, আমার ভাই, পিসেমশাই আর বোন, চারজন ব্রিজ খেলতে বসেছিলাম। দুপুরে খাবারে সময়ে সেটা সারা হলো, খেল খুব জমে উঠেছে। কথা ছিল আমি তিনটের পর লোকাল ধরে আক্রা থেকে মাঝের হাট গিয়ে, বাস ধরে হাওড়া যাবো। সাড়ে তিনটে নাগাদ বাস পাবো, আর পাঁচটা পর্যন্ত হাওড়া স্টেশন। ট্রেন ছাড়বে সাতটা।
"পিশো খেলা টি খুব জমে উঠেছে, ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা। তিনটে টি বাজলো। এবা উঠে বেরিয়ে পড়ি।"
পিশো বললো, "টিকিট যখন আছে তো বেরুতে তো হবে।"
পিসি জিজ্ঞেস করলো, "তোর ট্রেন কটায় রে?"
"সাত টা তে পিসি।"
"তাহলে তো চারটের লোকাল ধরলেও পৌঁছে যাবি। "
"সেটা তোমরা বেশি জানো। দিল্লী হলে আমি বলতে পারি। "
কথা বার্তার ভেতর তাস খেলা চলে চলেছে ।
"দাদা, মা কিন্তু ঠিক বলেছে, ৪এর লোকাল ৩:১৫ টি মাঝের হাট নামিয়ে দেবে। ওখানে প্রচুর বাস, আর অফিস এর ভিড় হবে আগেই তুমি ৫:৩০ এর আগে নির্ঘাৎ স্টেশন এ।"
"তা কিন্তু ঠিক," এবার পিশো. "ভিড় বাড়ার আগেই তুই পৌঁছে যাবি।"
"ঠিক আছে, তাহলে আরো কয়েকটা দান হয়ে যাক তাসের।"
তাসের খেলা কিন্তু নির্বিঘ্নে চলছিল, চলতে থাকলো। মাঝে দুটো দানের মাঝে উঠে উঠে সব জিনিস হাতের কাছে রেখে নিলাম। ভাই আমাকে ছাড়তে যাবে, সে ও নিজের জামা কাপড় পরে নিলো। সময় যেন নষ্ট না হয়ে।
ঠিক সময় বেরুনো হলো, ট্রেন, তারপর বাস ও পেয়ে গেলাম। বাস টি ও দুর্দান্ত গতি তে ছুটে পাঁচটার আগেই গঙ্গার বাবু ঘাট প্রিন্সেপ ঘাট পার করে স্ট্র্যান্ড এ, দাঁড়ালো। আমরা নিশ্চিন্তে আছি, সোয়া পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটার ভেতর হাওড়া ঢুকে যাবো।
'মনে মনে ভাবো তুমি খাবে চিঁড়ে দই, বিধাতা মাপিয়ে রেখেছে ধান সিদ্ধ্য খৈ,' এ কথা টা সেদিন মজ্জায় মজ্জায় বুঝলাম।
মিনি বাস দাঁড়িয়েই আছে, পাঁচটা, সোয়া পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা, এবার আমার আর ভাইয়ের টেনশান বাড়ছে।
পৌনে ছয়টায় আমরা দুজনে জিনিস নিয়ে নেমে পড়লাম। ফেরি ঘাট এ গিয়ে দেখি অকল্পনীয় ভীড় ভাই দৌড়ে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলো ভিড়ের ধাক্কায় কেউ নাকি জলে পড়ে গেছে আর ডুবুরি রা নদীর বুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওরা অনুমতি না দিলে ফেরি চলবে না। এবার ওপরে রাস্তায় এসে দুজনে দৌড় দিলাম। ভাই ফুটবল ইত্যাদি খেলত কিন্তু আমার তো বাস এর পেছনে দৌড়ানো ছাড়া আর কোনো দৌড় ঝাঁপ নেই, হাঁটতে নিশ্চই পারতাম। হাওড়া ব্রিজ এর কলকাতা মুখে যখন পৌঁছুলাম, আমি বোধ হয় পরে যাবো। হাত ঘড়ি তে ৬:৪০, এত লম্বা ব্রিজ, এতো অসম্ভব।
হঠাৎ করে যেনো ঈশ্বরের আশীর্বাদ, একটা ট্যাক্সি টার্ন নিচ্ছে হাওড়ার দিকে, খালি ট্যাক্সি। ভাই হাঁক দিতে এসে থেমে গেলো। আমরা দরজা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
আমার গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না, ভাই বলল, কালকা ধরতে হবে।
ড্রাইভার বলে উঠলো, "৩০ টাকা বার করে দিয়ে দিন, যদি মেন টেক্সী গেট এ যাই তো কালকা ধরতে পারবেন না। যেখানে বাস গুলো ঘোরে সেখানে রাস্তার কোন টা তে গেট দিয়ে ঢুকবেন। সাবওয়ে সিড়ি গেলেও ট্রেন পাবেন না। কোন টা তে ব্রেক লাগাতেই আপনাদের লাফিয়ে নামতে হবে। পুলিশ আমাকে দাঁড়াতে দেবে না। "
কথা বলতে বলতে স্টেশন এর দেওয়াল এর কাছে ট্যাক্সি ঘুরতেই আমরা দরজা খুলে লাফিয়ে পড়লাম। লাগিয়েই ছুট, কোচ নাম্বার ভাই কে বলা ছিল। এক রকম দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটছি। ৯ নম্বর প্লাটফর্ম এ ঢুকলাম, ঘড়ি তে ৬:৫৭।
তিন মিনিট, কোচ তো ইঞ্জিনের কাছে। পৌঁছুলাম, সঙ্গে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের যাবার ছিল, টিকিট আমার কাছে, উনি কোচ এর দরজায়, জিনিস দরজায়, ওনার শারীরিক আর মানসিক অবস্থা দেখে অন্য যাত্রীরাও টেনশন। কোনো রকম এ ঢুকলাম। ওনার আর অন্য যাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। এক জন গেলাস এ জল ঢেলে দিলো। জল খেয়ে বেসিনে গিয়ে মুখে চোখে জল দিলাম। বার্থ এ বসতেই একজন চা দিল।
আমার সাথী মিত্র মশাই জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার জিনিষ পত্র শুধু এদুটো থলে? জামা কাপড়ের ব্যাগ কই?" উনি জানতেন আমার কাছে ব্যাগ ছিল কারণ আমরা একসাথেই দিল্লী থেকে কলকাতা গিয়েছিলাম।
আমি বললাম, "জানিনা, আমার ভাইয়ের হাতে ছিল। আমি মনে করছিলাম যে ও পৌঁছে যাবে আমার আগে, আমি জানিনা জিনিষ কোথায়।"
ট্রেন লিলুয়া বেলুড় ছেড়ে দানকুনির দিকে ছুটছে, ট্রাফিক জ্যাম, ট্রেন, এ সব নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গেছে। আমি চড়তে পেরেছি সেটাই এক মাত্র শান্তি, জিনিস হারাবার শোক ত করবো, তার আগেই আওয়াজ শোনা গেলো, অনুপ মুখার্জি কেউ আছেন নাকি, দিল্লী যাচ্ছেন?
আমার সাথী মিত্র মশাই জোরেই উত্তর দিলেন, এখানে আছেন, কেনো কি হয়েছে?
জানা গেলো তার আগের কোচ এর দরজা দিয়ে চলতি ট্রেন এ আমার নাম আর কোচ নম্বর বলে একজন ব্যাগ টা ভেতরে ছুঁড়ে ফেলেছিল। যাত্রীদের হাতে হাতে ব্যাগ ত আমার কাছে এসে পৌঁছুলো।
সেদিন আর আজকের দিন, জীবনের সিদ্ধান্ত করে নিয়েছিলাম যে ট্রেন বা ফ্লাইট ধরার জন্য এক কি দু ঘন্টা আগে গেলেও ক্ষতি নেই।
কি বলেন পাঠক রা? সিদ্ধান্ত ঠিক তো?
Comments
Post a Comment