সময় বিভ্রাট অনেক সময় হয়ে। এটি একটা তেমন সময় বিভ্রাটের সমস্যা । সে অনেক দিন আগের ঘটনা ট্রেন টিকিট কম্পিউটার থেকে বেরুতে না। ছোট ছোট টিকিট দেওয়া হতো টিকিট এর জানলা থেকে আর টিকিট এর পেছনে পেন দিয়ে কোচ, বার্থ, তারিখ, সময় লিখে দেওয়া হতো। ট্রেন এর নাম আর স্টেশন এর নাম গুলি ছাপা থাকতো।
আর একটা ব্যাপার, তখন ২৪ ঘণ্টার ঘড়ির সময় তেমন একটা দেখা যেতো না। মানে আর কি যে দুপুর বারোটার পর একটা বাজবে সবাই ধরে নিতো। ১২ টার পর ১৩ টা বাজবে সেটার অভ্যাস খুব কম লোকেরই ছিল।
সেই সময় কলকাতা থেকে এক পরিবার'এর ৪ জন এলো আমাদের দিল্লীর বাড়ি। তাদের সঙ্গে আমাদের বাড়ির ৪ জন, সাকুল্যে ৮ জন যাবে রাজস্থান বেড়াতে। টিকিট আমরা কেটে রেখেছিলাম। কলকাতার মানুষ জন খাবারের ব্যাপারে একটু বেশি সৌখিন ছিল। শুক্র বার সকালে আমাদের বাড়ি এলো আর শনিবার রাতে ট্রেন। টিকিট দেখে সবাই বুঝলো রাত ৯:৫০ এ গাড়ি ছাড়বে। টিকিটের পেছনে ১৯:৫০ লেখার চেষ্টা টিকিট ক্লার্ক করেছিল, কিন্তু অত ছোট জায়গায় লিখতে গিয়ে ১৯:৫০ এর '১' তা কোচ এর সাথে মিশে গিয়েছিলো। সেটা ছিল সেদিনের পোস্ট মর্টাম করার পর জ্ঞান প্রাপ্তি।
যাক, বাবা একবার বললো যে প্রায় ১৫ বছর আগে এই গাড়ি তে গিয়েছিল তখন সন্ধ্যা বেলা ৭ টার পর ছাড়ত। হই চই এর মাঝে কথা টা ইতিহাস বলে সবাই উড়িয়ে দিল। প্ল্যান হলো কসা মাংস খেয়ে রওনা হবে, রাতের খাবার হিসেবে রুটি আর মাংস নিয়ে যাবে। সেই হিসেবে দুপুরের খাবার সেরেই মাংস বসানো হলো উনুনে। রান্না শুরু করা হলো এরকম হিসেবে যে ৭:৩০ এর ভেতর মাংস নেমে যায়। ৮ নাগাদ বেরুবে, ৯ এ স্টেশন আর ৯:৫০ এর গাড়ি যথেষ্ট সময় থাকবে। ট্যাক্সি পাওয়া যেত সহজে, সেটার চিন্তা ছিলো না।
আমি যাবনা, তাই আনুষঙ্গিক সেবার দায়িত্ব আমার। সেই অনুযায়ী বিকেল ৬ টার সময় এক থলে ভর্তি নোনতা আর বিস্কুট কিনছি তখন পাড়ার এক জন এর দেখা।
"কি রে, এতো স্নাকস কিনছিস, পার্টি করছিস কি বাড়ি তে?"
"না কাকু, দাদা দিদি আর কলকাতা থেকে আসা আত্মীয়রা রাজস্থান যাচ্ছে তাদের জন্য কিনছি।"
"রাজস্থান, রাত এগারোটার গাড়ি তে? ওটা তো বেশ স্লো গাড়ি।"
"না কাকু, ৯:৫০ এ গাড়ি।"
"৯:৫০ এ তো কোনো গাড়ি নেই। কোন ট্রেন এ যাচ্ছে রে? ৭:৫০ এর পর তো সেই রাত ১১ টা।"
"না, ওরা তো বলছে ৯:৫০। নাম জানিনা গাড়ির।"
ভদ্রলোক রেলওয়ে তেই কাজ করতেন আর দিল্লী রাজস্থান প্রায় করতেন। উনি বললেন, "ভালো করে দেখ, টিকিট এর পেছনে কী সময় লেখা আছে। দেখলি তোরা যখন স্টেশন গেছিস তখন ট্রেন দিল্লী বর্ডার ও পার করে চলে গেছে। টিকিট গুলো সব নষ্ট হবে।"
আমি ছুটলাম বাড়ি। ঢুকেই খবর দিলাম।।মাংস তখন উনুনে, আর সবাই তখন জিনিস গোছানো, রান্না, ইত্যাদি তে ব্যাস্ত। আমার ঘোষণা শুনে বাড়ির ভেতর যেনো ঘূর্ণি ঝড় আর ভূমিকম্প, দুটোই এসে গেলো। প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল অবিশ্বাস, "জানিনা কে তোকে কি বলেছে আর তুই ছুটে এসেছিস।" বাবা বলে দিল, "দাসীর কথা বাসি হলে মনে পড়ে, আর কি? আমি তো বলে ছিলাম ট্রেন ৭:৫০, তোমাদের বিশ্বাস হয় না। সব আমাকে বুড়ো হাবড়া মনে করো, এখন ভোগো।"
মা আবার বাবা কে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো, "খালি খালি বেকার কথা আর কী।"
একজন আবার বলে উঠলো, " ফোন করে খোঁজ নিলে হয়ে না?"
দাদা ছুটলো পাশের দোকানে, তখন বাড়ি তে ফোন ছিল না। কিছু মিনিট এ ফিরে এলো, "সত্যি তো ট্রেন টা ৭:৫০ e ছাড়বে।"
ঘড়ি তখন যেনো সইস এর চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মতন ছুটছে। আমি এসেছিলাম ৬:১০, দাদা ফোন করে এলো ৬:২৫। ইতি মধ্যে যাবার পাবলিকের কাপড় পরা হয়ে গেছে। আমার ওপর হুকুম জারি হলো, "দু মিনিটের ভেতর দুটো ট্যাক্সি নিয়ে আয়। আর তুই ও যাবি স্টেশন। একদম সময় নেই। এরা সবাই টাস্কি থেকে নেমে ট্রেন ধরতে ছুটবে, তুই ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিবি। তার পর ভেতর যাবি। দেখলাম আমি আর দাদা ছাড়তে যাবো ওদের সাথে ট্যাক্সি তে। ফেরার কোনো দিন কেউ চিন্তা করতাম না, নিজের শহর, রাত ১১ টা পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ফেরা যায়। "
কথা অনুযায়ী কাজ, শুধু দু মিনিট টা কথার কথা ছিল। যেতে পাঁচ মিনিট, দুটি ট্যাক্সি করতে আরো পাঁচ আর আসতে তিন মিনিট। ফেরত এলাম দুই খানা ট্যাক্সি নিয়ে তখন ৬:৫০। এর ভেতর আধা রান্না মাংস টাও রান্নার হাঁড়ি থেকে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার এ ট্রান্সফার করে প্যাক করা হয়ে গেছে। রুটি আর করা হয়নি। যখন আমি ট্যাক্সি আনতে গেলাম তো দাদা পাঁউরুটি নিয়ে এলো, রাতে ট্রেনে বসে সবাই মাংস দিয়ে খাবে, যদি আদৌ ধরতে পারে।
জিনিস সব নামানো হয় গিয়েছিল। ট্যাক্সি লাগার সাথে সাথেই জিনিস রেখে রওনা হতে দু তিন মিনিট লাগলো। জিনিস কোনোটাই ছাতে বা পেছনে রাখা হলো না, রাখতে নামতে সময় নষ্ট হবে। স্টেশন বাড়ী থেকে ১৫ কিলোমিটার, যেতে মোটামুটি ৪৫ - ৫০ মিনিট লাগে, সেটা ৪০ মিনিট এ যাওয়ার, তবে সেই সময় রাস্তা মোটামুটি পরিষ্কার, শুধু স্টেশন এ পৌঁছে সমস্যা হতে পারে। ট্যাক্সি ওয়ালাদের বলা ছিল ৭:৫০ এর গাড়ি। ওদের জওয়াব ছিল চেষ্টা করবে, গ্যারান্টি নেই ট্রেন ধরার।
ট্যাক্সি স্টেশন এ ঢুকল ৭:৪৫. যাদের ট্রেন ধরার ছিল সবাই নেমেই দৌড়ুলো প্লাটফর্মের দিকে। সিঁড়ি চড়ার সময় ছিলনা, আবার ছোট লাইন, মানে তখনকার মিটার গেজ; সেগুলি পুরানো দিল্লী স্টেশন এ ২০-২১ প্ল্যাটফর্ম এ ছাড়ত। সবাই রেল লাইন টপকে ট্রেন এ যখন ঢুকছে তখন গার্ড সবুজ ঝান্ডা দিচ্ছে। শেষ দু তিন জন তো চলতি গাড়ি তেই চড়লো।
আমি ইতি মধ্যে টাস্কি ওয়ালাদের ভাড়া দিয়ে প্রাণপণে ছুটলাম। দাদা ট্যাক্সি থেকে নেমে ওদের সাথেই ছুট মেরে ছিল, মাথায় একটা সুটকেস। আমি ভাড়া দিতে দিতে দেখলাম পাউরুটি টা ট্যাক্সি তেই, কোন রকমে ভাড়া মিটিয়ে ওটা নিএ ছুট। দূর থেকে দেখলাম লাইন টপকে সবাই যেন দিগ্বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে ছুটছে। কোচ টা সৌভাগ্যক্রমে সামনেই ছিল, দুটো দরজা দিয়ে সবাই উঠে পড়লো। দু তিন জন তো চলতি গাড়ি তেই উঠলো। ট্রেন প্রায় প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি পাউরুটি গুলো খোলা দরজা দিয়ে ছুঁড়ে ফেল্লাম। বেরিয়ে যাবার পর খেয়াল হলো দাদার কাঁধে একটা ব্যাগ, যাতে সবার দাঁত মাজার পেস্ট, ব্রাশ, চিরুনি, তেল, ক্রীম ইত্যাদি।
দাদা আর ভাই ব্যাগ দোলাতে দোলাতে, শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক করে, এক এক কাপ চা খেয়ে বাস ধরলাম। সেদিনের আমাদের শিক্ষা ছিল, ১৯ টা আর ৯ টার ভেতর দু ঘন্টার তফাৎ, আজ ও, কোনো মিটিং বা ট্রেন বা প্লেইন এর সময় ১৯ টা দেখলে, সেই দিনের কথা মনে পরে যায় ।
অনুপ মুখার্জী "সাগর"
Comments
Post a Comment