ট্রেন ধরা নিয়ে গল্পঃ বললাম, ট্রেন যাত্রার গল্পঃ হলো। এবার একটা এরকম গল্পঃ যেটা ট্রেন যাত্রার ঠিক না, তবে একটি যাত্রা, সঠিক বললে, এক
বার বেড়াতে যাওয়ার গল্পঃ। তাই এই স্মৃতি এখানে থান পেলো।
১৯৮০ দশকের কথা। কলকাতা গেছি একটা কাজ নিয়ে, বেশ কিছু দিন আছি। বন্ধু বান্ধব হয়েছে ভালই, তার ভেতর ৩ জন বাংলার অন্য অন্য জেলা থেকে। আমরা ৪ জন এক হোটেল এ থাকি, বয়স কম ছিল, এবং আড্ডা টা ভালই হতো।
তার মাঝে এক বার ৩/৪ দিন ছুটি এসে যাওয়া তে প্রায় সবাই বাড়ি যাবে। আমার বাড়ি যাওয়া মানে ২৪ ঘণ্টার ট্রেন, টিকিট এর সমস্যা, তার চেয়ে এক বন্ধু বললো, চল তোকে গ্রাম বাংলা দেখাই।
আমি লোভে পড়ে গেলাম। বুধবার রাত সিয়ালদাহ স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেল ধরলাম দুজনে। খুব ভোরে পৌঁছুব, রিজার্ভেশন করার দরকার মনে করিনি, চেপে গেলাম, পরের দিন ভোরে পৌঁছেও গেলাম।।
মালদা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা। গ্রামে বিশাল বাড়ি, এক সময়কার জমিদার, জমিদারি যাওয়ার পর কৃষি কাজ ছাড়া অন্য কাজ ও করেছে। একটি চালের মিল, একটি ছোট পোল্ট্রি, এই সব। বাড়ি তে বৃদ্ধা ঠাকুমা, সকাল বিকাল যৌথ পরিবারের পাত পড়ে ১৫ থেকে ২০ জনের।
পরের দিন টা সকাল বেলা আমি আর বন্ধু বড় উঠানের একধারে নিম গাছের তলায় চাতালে বিশ্বের আড্ডা মারছি। ঠাকুমা দালান এ বড় চৌকি তে বসে মালা জাপ করছে। উঠানের মাঝখানে দুজন মানুষ চাপাকল বা টিপকল ঠিক করছে। বাড়ি তে দুটো চাপাকল, তার একটা বাড়ির ভেতর। অন্য টা বাড়ির বাইরে, তার জল ঠাকুমা খায় না। শুনলাম ছত্রিশ জাতের ছোঁয়া কল, তার জল ঠাকুমা খেতে পারেনা, পুজোর ঘরেও সে জল উঠবে না।
এ জাতীয় কল ঠিক হলে তার ওপর থেকে জল ঢেলে দেখা হতো কাজ হয়েছে কিনা, ওরাও তাই করলো। উঠানে এক কোণে রাখা বালতি তে জল ছিল, সেটাই চাপাকল এ ঢেলে চালিয়ে নিলো, জল বেরুচ্ছে।
ঠিক সেই সময় ঠাকুমার চিৎকার, 'এই আধ দামড়া নষ্টের গোড়া, অকাল কুষ্মান্ড, আঁটকুড়ের বেটারা। বাড়ির জাত ধর্ম সব জলাঞ্জলি দিরি তোরা। '
ঠাকুমার চিৎকার শুনে আমি হতভম্ব, বন্ধু টি মস্করা করে বললো, দেখ আমাদের বাড়ির নাটক শুরু হলো। বড়ো শহরে এ দেখতে পারবিনা।
চিৎকারের প্রতিধ্বনি তে ওনার দুই ছেলে আর তিন বৌ যারা আসে পাশে ছিল বেরিয়ে এলো, কী হলো, কী হলো করে। ঠাকুমার রেকর্ড তখন উচ্চ সপ্তকে, "এ দিন দেখার আগে আমি চলে যেতে পারলাম না, হায় হায়, এ বাড়ির ধারা সব নষ্ট করবে আজকের ছেলে মেয়ে রা।' তারপর আমার বন্ধুর দিকে তীর ছুঁড়ে এলো, 'এই শহুরে ছেলে, বন্ধু না হয় প্রবাসী বাঙালি, কিন্তু তুই দু দিন কলকাতায় থেকে কি সাহেব হয়ে গেলি, এই দুটো মানুষ কল টা ঠিক করলো, তা ওদের বলতে পারিস না যে ভালো বালতি করে পুকুর থেকে জল নিয়ে কলে ঢালতে। ওঁরা এই আঁশ বালতি ভরে নোংরা জল ঢাললো আর তুই দেখলি। তার আগে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারলি না। "
বন্ধু টি হাঁসতে হাঁসতে বললো, "আরে ডার্লিং, আমি কী আর ওদের ওপর নজর দিচ্ছিলাম নাকি ? আমি তো তোমার থেকে বেশি মন দিয়ে পড়া সোনা করছিলাম। দেখো, তুমি জাপ করছিলে, কিন্তু চোখ ওদের দিকে, কারণ তোমার মন স্থির নেই। আমাদের তো মন মাথা পড়ায় স্থির ছিল, কি করে দেখবো বলো। " ইয়ার্কি করে নাতি রা ঠাকুমা কে আর নাতনি রা ঠাকুর্দা কে ডার্লিং বলে, ইটা জানতাম। কিন্তু আঁশ বালতি? আর তার পর এলো আঁশ চাপা কল ?
বিস্তর কথা বার্তার পর বুঝলাম , ঠাকুমার আর সেই কলের জল খাবে না। চাপা কল টি এখন আঁশ, তার থেকে যে জল বেরুবে, সেটাও আঁশ! তৎক্ষণাৎ লোক এলো, দু দিন ধরে নতুন কল খোঁড়া হলো, লাগানো হলো। এই দু দিন ঠাকুমা বাড়ির জল খাননি। দুধ খেয়ে তেষ্টা মেটান, বা গঙ্গা জল খেয়ে। এমন কি ভাত না খেয়ে পায়েস খেলেন কারণ সেটা দুধ দিয়ে, আর রুটি খেলেন দুধ দিয়ে আটা মেখে। বন্ধু টি কে বললাম, জল সেই একই মাটি থেকে আসছে, তার আবার আঁশ নিরামিষ কি রে, এ বালতি তো ধুলেই পরিষ্কার। বন্ধু টি বললো, আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি, মাথা ঘামাইনা না রে। বোঝানো তো যাবেনা, খামোকা ওই বৃদ্ধা কে দুঃখ দিয়েই বা কী লাভ।
অনুপ মুখার্জী "সাগর"
Comments
Post a Comment