প্রথম ভাগে পড়লেন এক দুর্ভাগ্য জনক হতাশার কাহিনী, দ্বিতীয় ভাগে পড়লেন এক গল্প যেখানে লেখক কে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলো - আশার আলো ছড়িয়ে দিলো,।
এবার পড়ুন একটি উত্তেজনা ভরা ট্রেন যাত্রা ।
বোধ হয় ১৯৯১ সনের কথা, কোনো কাজ এ দিল্লী থেকে পাঞ্জাব হয়ে উত্তর প্রদেশ এর মোরাদাবাদ যাবার ছিল। সন্ধ্যের দিকে চন্ডিগড় থেকে বাস নিয়ে আম্বালা এলাম আর ঠিক করলাম ট্রেন এ মোরাদাবাদ যাবো। মাঝ রাতের কাছাকাছি অমৃতসর হাওড়া এক্সপ্রেস এলো। সামনে আর্মি কোচ ছিল, চড়ে পড়লাম। ভিড় না থাকা তে বিশেষ কিছু আপত্তি কেউ করলো না, শুধু এক জন বললো এটা আর্মী কোচ, আর আমি বলে দিলাম আমি আর্মি তেই কাজ করি। বসার জায়গা ছিল, বসে বসে মোটামোটি সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। সাহারানপুর, লাক্সার হয়ে নাজিবাবাদ, তারপর মোরাদাবাদ। নাজিবাবাদ থেকে মোরাদাবাদ প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তা আর মাঝে ট্রেন কোথাও দাঁড়াবে না।
আমি ভেতরের সীট গুলোর একটা তে বসে, আমার সামনে জানালার পাশে একা সীট এ এক মহিলা, ওনার ব্যাগ টা কোলে নিয়ে খোলা জানালার গ্রিল এ মাথা ঠেকিয়ে ঝিমোচ্ছেন, হাওয়া খাচ্ছেন আর যেমন ট্রেন এ হয়ে, মাঝে মাঝে এদিক ওদিক সবাই তাকিয়ে নেয়, উনিও তাকিয়ে নিচ্ছেন। নাজিবাবাদ থেকে ট্রেন তা ছাড়লো। কম্পার্টমেন্ট এ সবাই আর্মির লোক, এটা পাঠক রা মনে রাখবেন।
নাজিবাবাদ প্লাটফর্ম থেকে আমাদের কোচ টা তখন বেরোয়নি, গাড়ি স্পিড ধরে নিয়েছে, হঠাৎ সেই মহিলা চিৎকার করে উঠলেন আর ভয় পেয়ে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠলেন। চিৎকার এ সবার ঘুম ভেঙে গেলো, মহিলার দিক দুজন ছুটে গেলেন, বোঝা গেলো ওনারা একসাথে আছেন।
কী হলো, কী হলো, একটা শোরগোল পড়ে গেলো।
মুহূর্তে ভেতর সবার নজর গেলো জানালার ডাণ্ডা ধরে একজন লোক ঝুলছে, প্লাটফর্ম ছেড়ে তখন ট্রেন পুরো দমে দৌড়েছে। সে চেচাঁচ্ছে, বাঁচাও, বাঁচাও, পড়ে যাচ্ছি, বাঁচাও।
তৎক্ষণাৎ চেন টানা হলো, কিন্তু ট্রেন দাঁড়ালো না।
দুজন তাড়াতাড়ি লোক টার হাত চেপে ধরলো, ট্রেন এ ঝাঁকুনি তে সে লোক টা ধরে রাখতে পারছিলো না। এর ভেতর বেশ কয়েকবার চেন টানা হয়ে গেলো, কাকস্য পরিবেদনা। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না চেন টেনে।
পাঁচ সাত মিনিট গেলো, এবার যারা হাত ধরে ছিল, তাদের হাত থেকে লোক টার হাত পিছলে যাচ্ছে, ট্রেনের ঝাঁকুনি আর চেপে ধরার কারণে ঘাম, আর অতক্ষণ একজন সমত্ত মানুষ কে ধরে থাকা সম্ভব না এটা সবাই বুঝতে পারছিলো। হাত চেপে ধরে থাকার লোক পাল্টাতে থাকলো, এবং বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে বেশিক্ষন ঝুলন্ত লোক টা কে এভাবে ধরে রাখা যাবে না। ভেতর থেকে চারজন ধরে ছিল কিন্তু জানালা থেকে ধরে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো।
আলোচনা গরম ভেতরে, আলোচনার একমাত্র বিষয়ে ছিল ট্রেন কি করে রোখা যায় আর লোক টা কে কি করে বাঁচানো যায়। এক দু জন বলে উঠলো যে ও কি করতে ডাণ্ডা ধরে ঝুললো, কিছু অভিসন্ধি ছিল কি. কিন্তু সে কথার কেউ দাম দিলো না। আলোচনা শুধু একটাই, লোক টা কে বাঁচানো। এর ভেতর কটা স্টেশন গেলো, আর প্রতি টা স্টেশনে সবাই চিৎকার করতে থাকলো, কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া গেলো না, ট্রেন থামলো না।
ততক্ষনে প্রায় দশ মিনিট, ট্রেন পৌঁছুবে মোরাদাবাদ একঘন্টা কুড়ি মিনিট এর দৌড় এর পর। দুজন সর্দারজি নিজেদের ব্যাগ খুলে পাগড়ির কাপড় বার করে দিলো। সবাই মিলে মানুষ টা বাঁচিয়ে রাখার প্ল্যান হলো, পাগড়ির কাপড় ওর কোমরে জড়িয়ে পাশের জানালা থেকে টেনে ধরে তুলে নেয়া হলো। দুজন হাত ধরে ছিল, ওর বগলে আর একটা কাপড় জড়িয়ে আরো দুজন ধরলো। এবং এবার কোমরের কাপড় টা দুজন আর বগলের কাপড় টা দুজন, এ ভাবে টেনে ধরে থাকা হলো। কোমরের কাপড় টা টেনে নিয়ে মানুষ টা কে মাটির সমান্তরাল ঝুলিয়ে ধরে নেয়া হলো।
চিন্তা করা যায় না, ট্রেন ছুটছে প্রায় ১০০ কি মি গতি তে, আর বাইরে জানলায় একজন ঝুলছে, শুধ কাতরে যাচ্ছে, মরে যাবো, বাঁচাও। আর ভেতর থেকে প্রায় দশ বারো জন সে কাপড় ধরার হাত পাল্টাচ্ছে।
ট্রেন থামাবার নানা রকমের চেষ্টা চলছে। দু জনের কাছ ভালো টর্চ ছিল, লাল কাপড় ও পাওয়া গেলো। বেশ খানিক টা সময় সেই টর্চ জ্বালিয়ে লাল কাপড় বেঁধে গার্ড এবং ড্রাইভার, দুজন এর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হলো। স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে, প্লাটফর্ম এ কর্মচারী দের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালু থাকলো, কোনো লাভ হলো না।
ট্রেন প্রায় ৩৫ মিনিট ছুটে নিয়েছে, এক জন বললো স্টপ তো নেই কিন্তু কখনো হয়ে না যে সব সিগন্যাল পেয়ে এভাবে গাড়ি দুর্দান্ত গতি তে ছুটবে। কোথাও তো দাঁড়াবে, সিগন্যাল পাবে না। কিন্ত না, সেদিন যেন ট্রেন এক অবাধ দুর্বার গতি তে ছুটছে।
এক জন কোচ এর ভেতরের লাইট এ ঢাকনা ভেঙে ফেললো। সেখান থেকে দুটো বাল্ব খুলে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। আর একটা স্টেশন আসছে, দুজনের হাত দুটো বাল্ব। একটি বাল্ব ছুঁড়ে মারা হল স্টেশন মাস্টার এ ঘর দিকে, সেখানে তিন চার জন দাঁড়িয়ে ছিল। বোঝা গেলো যে বাল্ব তা ঠিক জায়গায় পড়েছে, কিন্তু সিগন্যাল দেয়া হতে থাকলো, গাড়ি থামাবার কোন চেষ্টা ওদের দিক থেকে হল না। প্লাটফর্ম শেষে পরে একটা সিগন্যাল কেবিন এও একটি বাল্ব মারা হলো, কোনো কেউ ট্রেন রোখার কিছু করলো না।
ট্রেন নিজের দুর্দান্ত গতি তে ছুটতে ছুটতে মোরাদাবাদ স্টেশন এ ঢুকছে, প্লাটফর্ম তখন পুলিশ এ ছেয়ে আছে। রেল পুলিশ, সিটি পুলিশ, শত খানেক না বেশি, বলা যাবেনা। কোনো যাত্রী, কুলি, কেউ কাছে নেই, দড়ি দিয়ে সবাই কে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। প্লাটফরমএ শুধু পুলিশ আর পুলিশ।
ট্রেন থামলো, আমাদের কোচের সব কটা দরজার সামনে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধের জন্য যেন তৈরী পুলিশ। শুধু প্লাটফর্ম না, যেদিকে প্লাটফর্ম নেই, সেখানেও পুলিশ অন্য লাইনে, পুরো দস্তুর রাইফেল বন্ধুক, সব হাতে। থামার সাথে সাথে বাইরে যে লোক টি ঝুলছিলো তার দিকে অনেকে ছুটে এল, ওকে নামিয়ে নিলো। রেলওয়ে অফিসার ও কজন ছুটে এল।
কাহিনী পরিষ্কার হলো।
নাজিবাবাদ এর পর দ্বিতীয় স্টেশন থেকে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে আর্মি কম্পার্টমেন্ট এ কিছু গন্ডগোল হয়েছে, আর রেলওয়ে পুলিশ এর মত ছিল যে হয়তো ডাকাতি করার চেষ্টা হয়েছে। চেন টানলে ট্রেন দাঁড়াবে না জানা ছিল, তাই মোরাদাবাদ স্টেশন এ সব ব্যবস্থা করা হলো, ড্রাইভার কে রেডিও ফোন এ বলে দেওয়া হলো ওর সব সিগন্যাল সবুজ থাকবে, ও যেন স্পিড কম না করে। একঘন্টা কুড়ি মিনিটের রাস্তা একঘন্টা পাঁচ মিনিট এ চলে এলো। একজন চেকার সেই লোক টা কে দেখে বললো যে বিনা টিকিট এ লাক্সার এ চড়ার চেষ্টা করছিলো, দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, চেকার নামিয়ে দিয়েছিলো। তারপর হয়তো কোনো দরজা দিয়ে কোনো কোচ এ চড়ে গিয়েছিলো।
যে মহিলা টি জানালার কাছে ছিলেন, তাকে দেখে পুলিশ আর চেকার বললো যে ওনার গলায় ভালো দেখতে চেন ছিল, আর খুব সম্ভব লোক টা ওই চেন তা টানার জন্য ট্রেন ছেড়ে দেবার পর আসে কিন্তু নেশা করার জন্য সে জানালার ডাণ্ডা ধরে ঝুলে পড়ে, গলার চেন তা টানতে পারেনি।
পুলিশ সেই মহিলার আর যারা লোক টা কে প্রাণে বাঁচালো তাদের দু তিন জনের জবান বন্দি নোট করে সেই লোক টা কে নিয়ে চলে গেলো। আমিও ট্রেন থেকে নেমে নিজের গন্তব্য স্থলের দিকে যাবার চিন্তা করলাম। ৩০ বছরের বেশি হয়ে গেলো, এখনো সেই এক ঘন্টা যেন চোখের সামনে ভাসে।
অনুপ মুখাৰ্জী "সাগর"
Comments
Post a Comment