মরণ ভয়
আজ প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেল, সেই ঘটনা, না না, ঘটনা না, দুর্ঘটনা টা ঘটেছিল। আজ আমার দাদার কথা অনেক মনে হচ্ছে সকাল থেকে। নিজের পুরনো শহর দিল্লি তেই আজ ২০ বছর পর এলাম, নিজের ছেলের শ্বশুর বাড়ির একটি বিয়ের অতিথি হিসেবে। মনে একটা বড় রকম পুরানো ক্ষতির ঝড় নতুন করে বয়ে গেল যখন দেখলাম যে বিয়ের হোটেল টা তো আগের একটা বড় মতন বাংলো ভেঙে তার জায়গায় হয়েছে যেখানে ৪০ বছর আগে এসেছিলাম দাদার বিয়ে দিয়ে বৌদি কে নিয়ে যেতে, নিয়ে গেলাম সেদিন দাদার মরদেহ!
আমি ঊর্মি, তৃতীয় সন্তান, দুই ভাইয়ের পর বোন, সবার আদরের নিঃসন্দেহ। দুই দাদা কে চিরকাল বড়দা আর ছোড়দা বলেই ডেকেছি। দাদা বলে ডাকতাম আমার জেঠুর ছোট ছেলে কে। জেঠু আর বাবা দিল্লি শহরে আগে পাসাপাসি থাকত, আর ওনার ছোট ছেলে আমার থেকে ১৫-১৬ বছর বড় ছিল, কিন্তু আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তাকে শুধু দাদা বলতাম, আর দুই বাড়িতেই বলা হত যে এরা হল সত্তিকারের ভাই বোন। দাদা আমার শুধু দাদা না, আমার বন্ধু, আমার গাইড, আমার টিচার, খেলার সাথি, অনেক কিছু ছিল। এরম কখন হয়েনি যে মা বাবার সাথে জেঠুর বাড়ি গেলাম, আর দাদার কাছে থেকে গেলাম না বিশেষ যখন স্কুল বন্ধ। আবার অন্য রকম নিশ্চয়ই হত যে বাড়ি থেকে পুরো প্লান করে গেলাম যে শনিবার রবিবার জেঠুর বাড়ি তেই থাকব, কিন্তু গিয়ে দেখি দাদা হয়ত বাইরে গেছে তো আমি বাড়ি ফিরে এলাম। অনেক সময় দাদা এসে আমাদের বাড়িতে থাকত, আর জখনই আমরা দুজনে এক সাথে হতাম, রাতে বকুনি না খেয়ে আমরা কখনই ঘুমোতাম না। শুধু জাঠতুতো খুড়তুতো ভাই বোন না, আমাদের সম্পর্ক ছিল বিশ্বাস, ভরসা, আর ভালবাসার ।
সবাই বড় হতে শুরু করলাম, পাসাপাসি ছোট বাড়ি গুলো উঠে গেল, শহরের দুটি আলাদা প্রান্তে আমাদের বাড়ি হল, ছোটবেলার ছুটে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এর মাঝে আমার বড়দার বিয়ে হল, আর প্রথম পরিনতি হল আমাদের বাড়ির শান্তি নষ্ট হল। সময়ের সাথে দাদা নিজের কাজে ডুবে যেতে লাগ্ল, আমিও কলেজ পাস করে একটা ছোট মতন অফিস এ কাজ নিলাম। দাদা প্রতি মাসে এক বা দু বার তো এসেই যেত আমাদের বাড়ি, কিছু কথা, গল্প তখন হত। আমি তিন চার মাস এ একবার প্রোগ্রাম বানাতাম, দিন কতক ছুটি হবে, দাদা বাড়ি থাকবে, এসব দেখে জেঠুর বাড়ি যেতাম। প্রায় রাত জেগে আমাদের গল্প হত। দাদাই ছিল যার সাথে আমি আমার স্কুল, কলেজ বা অফিসের গল্প করতে কখন দুবার চিন্তা করিনি। জেঠিমার বকুনি ও আদরের হত, হয়ত আমাদের সাথেই বসে পড়ল গল্প করতে।
জল বয়ে যেতে থাকল, জেঠুর বড় ছেলের বিয়ে হল, আর এক বছরের ভেতর অশান্তির চরম সীমা পার করে সংসার ভেঙ্গে গেল। দিদি দের ও বিয়ে হয়ে গেল এক এক করে, আর এবার সবাই দাদার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগার প্লান করল। কিন্তু দাদার এক কথা, বিয়ে করবনা। কি হবে বিয়ে করে, কার বাড়ি তে শান্তি এসেছে বিয়ে করে, ইত্যাদি প্রকৃতি। মা বাবা, সব আত্মীয় বন্ধু দাদার পেছনে পড়ে থাকত বিয়ের জন্য আর দাদা ধীরে ধীরে অধৈর্য আর প্রচণ্ড বিরক্ত হতে শুরু করল। মাঝে মাঝে হঠাত করে চলে আসত, অনেক রাত করে বেরুত। বলত, জানিস ঊর্মি, সবাই বিয়ে বিয়ে করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে, কি পাবে এরা আমি বিয়ে করলে।
এক দিন মা বাবা জেঠুর বাড়ি তে গিয়েছিল, সেদিন দাদা কে নিয়ে সবাই বসেছিল। সন্ধ্যে বেলা দাদা আমাদের বাড়ি, জানিস ঊর্মি, আজ এরা সবাই আমাকে বাধ্য করেছে এদের কথায় রাজি হতে, তবে আমি তোকে এই বলে রাখছি, এরা যদি সত্যি আমার বিয়ের জন্য এগোয়, আমি কিন্তু বিয়ের দিন মরে যাব, দেখিস। আমি দাদার মনের ভয়ে জানতাম। সংসার আরও ভাঙ্গুক সেটা দাদা কিছুতেই চাইত না। আমি কিছু টা বোঝাবার চেষ্টা করলাম, 'এরকম ভেব না। তুমি যখন নিজের সিধান্তে অনড় থাকবে তো বউদিকেও তোমার কথা শুনতে হবে। আর সব মেয়ে কি খারাপ দাদা, আমরাও তো আছি, যে আসবে সে আমাদের মতন তো হতে পারে। দেখ দিদি রা তো সংসার ভাঙ্গেনি।'
দাদার বিয়ে ঠিক হল, এক বার ছেলে মেয়ে দেখা করানো হল। তারপর একটি দিনের জন্য ও দাদা নাম করেনি যে নিজের হবু বউ এর সাথে দেখা বা কথা বলুক। সে যেন নিজেকে কাজের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে থাকল। যে দাদা ভাষা নিয়ে খেলত, কৌতুক যার কথায় ভরা ছিল, মুখে যার সব সময় এক স্মিত হাস্য থাকত, তার কৌতুক যেন হারিয়ে গেল, মুখের হাসি যেন কালবৈশাখীর মেঘের ঝড়ের ঝাপটে মুছে গেল। কখন কোন বন্ধু বা আত্মীয় তাকে একটু ক্ষেপিয়ে মজা করতো, আবার দিদিরা বলতো এত দুশ্চিন্তা করিসনা সব ঠিক হবে। কিন্তু দাদা প্রতি দিন গম্ভিরতার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকলো। কেউ কোনো কাজ বললে করে দিত, তার চেয়ে বেশি কিছু না।
বিয়ের দিন এসে গেলো। কনে বাড়ি অন্য কোনো শহরে ছিল, কোথায়, সেটা আমার মনে নেই। বিয়ে দিল্লি তে হবার ছিল আর একটা বাংলো বাড়ি ভাড়া করা হইছিলো বিয়ের জন্য। মেয়ে বাড়ির সবাই তার পাশেই কোনো হোটেলে উঠেছিল।
বিকেল বেলা আমি, দিদিরা আর দাদার যাবার কথা ছিল আগেই আমরা মোটামুটি মেকআপ সেরে পুরো দস্তুর ওখানেই তৈরি হবো। দুই দিদি, দাদা আর আমি প্রায় ছটা নাগাদ পৌঁছুলাম। দীদীরা আমাকে দাদার সঙ্গে থাকে বলে নিজেরা ব্যাবস্থা দেখতে চলে গেলো। বিরাট বাংলো, তার বিরাট হলঘর। মাঝখান টা তে একটা খুব সুন্দর করে বসার জায়গা বানানো, সোফা ইত্যাদি লাগানো, পুরো বসার জায়গা টা হলঘরের মেঝে থেকে 4 -6 টা সিড়ি নেবে। সেখান টা তে গিয়ে দাদা কে বললাম, চলো দাদা ওখানে বসি।
সকাল বেলা দাদা দু তিন বার আমাকে বলেছিল, জানিস, আজ আমার বিয়ের দিন না, মৃত্যু দিন। আমি ধমক দিয়ে চুপ করিয়েছিলাম।
ওই চার পাঁচ কদম নেমে যেতে দাদা আটকে গেলো, মানা করে দিল, আমি যাবো না। দাদার চেহারা যেন একদম পাল্টেগেল, শরীরের রক্ত যেন কেউ শুষে নিয়েছে, হাত একদম বরফের মতন ঠান্ডা। খালি এক কথা, 'ওই নিচে, ওই গভীরে নামার চেষ্টা করিস না সোনা। শোন্ উর্মি, আমার কথা শোন উর্মি, ওটাই তো আমাদের মারার ফাঁদ, ওই গভীর এ নামতে গেলে আমরা তলিয়ে যাবো, আমি মরে যাবো, যাস না ওখানে, যাস না বলছি।
আমি কি করবো বুঝে উঠছে পারছিনা, যে দাদা চিরকাল আমাকে রাস্তা দেখিয়ে এসেছে, আজ তার এ কী কথা বার্তা। আমি দাদার হাতধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম, বলতে বলতে, দাদা তুমি কেন ভয় পাচ্ছো , এই দেখো এই তো মাত্র চার পাঁচ তা সিঁড়ি, আর কি সুন্দর বসার জায়গা। দাদা হঠাৎ চিৎকার , করে উঠলো, উর্মি যাস না, আমি তোকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেও পারবো না কারণ এইটা আমাদের মরণ ফাঁদ। আমি মরি, কোনো কিছু না, তুই বেঁচে থাক, যাসনা, কথা শোন, উর্মি, যাসনা।
দাদা প্রায় দুটো সিঁড়ি লাফিয়ে নিচে নামলো, আর পড়ে গেলো। পড়ে যেতেই আমি ঘাবড়ে গিয়ে দাদার পাশে বসলাম, ধাক্কা দিচ্ছি, দাদা, দাদা, কিহলো, ওঠো, ওঠো। কিন্তু আমার দাদা পড়েই রইলো, নিশ্চুপ, নিথর, স্থির, পাথর, হাত পা ঠান্ডা। আমি তখন চিৎকার করছি, বিক্ষিপ্ত চিৎকার, দাদা, দাদা, আবার ডাকছি, দিদি, দেখো দাদার কী হয়ে গেছে। দিদি রা ওপর এর ঘর থেকে নিচে ছুটে এলো, এক জন দাদা কে ডাকছে, মুখে জল দিচ্ছে, অন্যজন আমাকে সামলাবার চেষ্টা করছে। তখন আমিও পাগলের মতন।
কিছু আত্মীয়, কিছু কাজের লোক তখন এসে গিয়েছিলো। একজন গাড়ি বার করে দাদা কিছু লোক নিয়ে ধরা ধরি করে গাড়ি তে তুলে দিলো, হাসপাতালে নিয়ে গেলো ওরা। আমার, দিদি দের , আমাদের তখন আর পারিপার্শ্বিক কোনো জ্ঞান নেই। লোক জন জড়ো হচ্ছে। যেহেতু আমি ছিলাম দাদার কাছে, সবাই আমাকেই জিগ্যেস করছে, আর আমার মাথায় দাদার কথা গুলো ঘুরছে, এইটা বিয়ে না রে, এ তো আমার মৃত্যু যাত্রা।
প্রায় এক দু ঘন্টা পর যে ভদ্রলোকের গাড়ি করে দাদা কে হাসপাতাল নিয়ে গিয়েছিলো, ওনার গাড়ি তে দুজন পুলিশের লোক এলো। দাদা নাকি পড়ে যাবার সাথে সাথে মারা গেছে, কোমরের হাড় খুব বাজে ভাবে ভেঙে গেছে। পুলিশ আমাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করলো, কোথা থেকে লাফিয়েছে , বা কেউ ধাক্কা দিয়েছে ? ওরা মানতে চাইছিলনা যে দাদা শুধু দুটো সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেছে। বিশ্বাস, তো সত্যি কথা বলতে, আমাদের কারও হচ্ছিলোনা।
পুলিশের লোকেরা চলে গেলো, সাধারণ মৃত্যু নয় তাই পোস্টমর্টেম হবে। মেয়ে বাড়ি থেকে ও লোকজন এসেছিলো, ওরা খবর পেয়ে গিসলো, তবে ওরা কে কি করলো আর বললো আমি জানিনা। আমি খালি চেঁচিয়ে যাচ্ছিলাম, কেঁদে যাচ্ছিলাম, আমাকে কয়জন মিলে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ওখানে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। দু দিন পর আমি ছাড়া পেয়েছিলাম, নিজেকে সামলে নিয়ে, যদিও যেন অন্য এক মানুষ। আমার দাদা ছাড়া আমি নিজেকে কোনো দিন ভাবিনি, আর সেই দাদা হারিয়ে গেলো। দাদা কেও হাসপাতাল থেকে সেদিনকেই ছেড়েছিলো। দাদার মুখের কথা ফলে গেলো, বৌ নিতে গিয়ে দাদার মরদেহ নিয়ে ফিরলাম সবাই।
দাদার শ্রাদ্ধের পর আর আমি জেঠুর বাড়ি যেতে পারিনি। আমার যেন পুরো শহরটাই খেতে আসতো। সময়ের সাথে দুঃখ চাপা পড়ে যায় নতুন দুঃখ, নতুন সমস্যার ওজনের নিচে, সবার হয়, আমার ও তাই হয়েছিল। কিছুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে আমি দিল্লি ছেড়ে চলে গেলাম তার পর আর সেরকম ভাবে দিল্লি আসা হয়নি। জেঠু, জেঠিমা, মা, বাবা, সবাই নিজের মতন আমাদের মায়া কাটিয়ে ওপরে চলে গেছে এর মাঝে।
আজ চল্লিশ বছর পর, এই বিয়ে বাড়ি তে বসে আমি চোখের বাঁধ র ধরে রাখতে পারছিনা, এরকম করে কেউ ছেড়ে যেতে পারে ? শুধু তার আগে যাদের বিয়ে হয়েছে তারা পরিবার কে ধরে রাখতে পারেনি বলে সে চলেই গেলো? নাকি আমরা, আমাদের বড়োরা তাকে বুঝতেই পারলো না, আর তাকে ঠেলে দিল, মৃত্যুর দিকে ?
জবাব নেই আমার কাছে , শুধু বুক তা দুমড়ে উঠলো, একটা শব্দহীন আর্তনাদ যেন চারিদিকে ধ্বনিত হলো, "দাদা, দাদা, তোমার কী হলো দাদা, ওঠো দাদা, প্লিজ ওঠো। দাদা... দাদা..."
অনেক সময় জানার চেষ্টা করেছি যে এমনি করে কি কারো শরীরে হাড় ভাঙতে পারে, হার্ট এ্যাটাক আস্তে পারে। এক মনস্তত্ত্ববিদ বলেছিল যে অসম্ভব না, দোষ কোটি তে একটা ঘটনা ঘটতেই পারে। আমি বলতাম আমার দাদা লাখে ও এক পাবে না, কিন্তু এই 10 কোটির এক মৃত্যু আমার দাদা কে কেনো নিল? জবাব নেই।
অনুপ মুখার্জি
Comments
Post a Comment