ট্রেন যাত্রা তে সাধারণত মানুষ কিছু খাবার নিয়ে যায়, কিছু রাস্তায় কিনে খায়। আবার আমার মতো কিছু মানুষ বাইরে খেতেই ভালোবাসে। বাইরে খাবার ও সঙ্গে গল্পঃ।
আমি আজ একটি ঘটনা বলবো যেদিন এর থেকে বেশি এলাহী খাবার আমি ট্রেন এ খাইনি।
এর আগের যে কালকা মেল ধরার ঘটনা শুনলেন, আজকের বর্ণনা তার ধারাবাহিকতা তেই।
হাওড়া থেকে কালকা মেল ছাড়ার পর প্রায় আধা ঘন্টা লাগলো সম্পূর্ন ধাতস্ত হতে। হাত মুখ ধুয়ে, চা জল খেয়ে তারপর জিনিস পত্র ঠিক করলাম। সাথী, মানে খগেন বাবু কে জিজ্ঞেস করলাম, রাতের খাবার কি করবো।
খগেন বাবু আমার বয়জেষ্ঠ। কাজের সুত্রে আলাপ তবে দাদা বলতে সংকোচ হতো। ওনার ছেলে আমার থেকে বড়, অনেক বাবু বলতো, আমিও ওনার ছেলের মতন অনেক বাবু সম্বোধন করতাম।
গল্পের অন্য চরিত্র বর্ধমানের সদানন্দ দাস। আমাদের বন্ধু। আজ দুজনেই এই দুনিয়া তে নেই, ওনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, ওনাদের আপ্লুত করা স্নেহ কে মনে করে এই ঘটনা।
"যাক, তুমি শেষ পর্যন্ত এলে," বাবু বললেন। " আমি তো টেনসন এ পাগল গিয়ে যাবার জোগাড়। সবাই বলছিলো আজ স্ট্রান্ড e প্রচণ্ড জ্যাম, তবে তুমি হাতে সময় নিয়ে বেরুবে তো। টিকিট টা তোমার কাছে। আমি চেকার কে দুবার জিজ্ঞেস করলাম, যদি তুমি না আসতে পারো, আমি কি যেতে পারবো? তা উনি পরিষ্কার জবাব দিলেন না। আর যদি চলেও যায়, আবার দিল্লী স্টেশন এ যদি বেরুবার সময় ধরে! উফফ, কি যে করো তোমরা ছেলে ছোকরা রা।"
" সত্যি বাবু, আমি তো মনে করছিলাম যে এবার বোধ হয় ট্রেন ফেল করবো। বিশ্বাস করা যায় না দিল্লী তে থেকে যে স্ট্রান্ড এ এক জায়গাতেই বাস দাড়িয়ে রইলো দেড় ঘণ্টা। নাক খত দিচ্ছি আজ বাবু, কলকাতায় ট্রেন ধরার হলে দু ঘণ্টা আগে এসে বসে থাকবো তাও ভালো।"
" আমরা তো তাই করি, আমি নিজেই পাঁচটার আগেই এসে গেছি। অফিস টাইম, কিছু বলা যায়না। "
"তবে এত পরিশ্রম করলে, রাতের খাবার টা আশা করি ভালই হবে।"
"আপনি বলেছেন সদানন্দ দা কে? আনবে তো?"
"আনবে তো মানে? আরে নিশ্চই আসবে। কোচ আর সিট বলা আছে। আমি তো ভাবছিলাম যদি না আসো তো ওকে জানাবো কি করে। ও বেচারা বাড়ি থেকে আসবে খাবার নিয়ে।"
"কী আনতে বলেছেন?"
"বলেছি লুচি, আলুর দম আর দুটো মিষ্টি নিয়ে আসবে, তবে কি আনবে এটা ও নিজেই ঠিক করবে।"
কথা বার্তায় আর কিছু রাজনৈতিক তর্জায় সময় কেটে গেলো, ট্রেন বর্ধমান এ ঢুকলো। স্থির হবার আগেই দেখি সদানন্দ দা চলতি ট্রেনেই এক বস্তা নিয়ে উঠে পড়েছে।
আমাদের বার্থ এ এসে দেখালেন, তিনটে প্যাকেট, শালপাতার থালা, বাটি সহ, পাতার জন্য খবরের কাগজ, দুটো ছোট গামছা। প্যাকেট গুলো বলে দিলেন, রাতের, সকালের জল খাবার আর দুপুরের। আমাদের তো চক্ষু চড়ক গাছ।
বাবু বলে উঠলেন, " হে ভগবান, এক কি করেছ রে সদানন্দ। রাতের খাবার টা শুধু নিয়ে আসতে, এ তো এলাহী কান্ড। ট্রেন এ এত কেউ খায় না কী?"
সদা- "দাদা, তুমি হলে আমাদের দাদা, আর রয়েছে আমার এই ভাই টি। পারলে ট্রেন থেকে নামিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়াতাম, কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। অল্পই এনেছি, জানিনা পেট ও ভরবে কি না।"
আমি বললাম, "দাদা, আমার মনে হয় না আমরা শেষ করতে পারবো। কিছু না হয় নিয়ে যাও। আর ট্রেন এ বসে কি আর ইলিশ খাওয়া যায়।"
"আরে ভাই ইলিশ খাবে তোমরা, তাতে কোথায় বসে খাচ্ছো তাতে কি তফাৎ পড়ে গো ভাই। আর একদম মচমচে ভাজা। ভালো লাগবে।"
সদানন্দ নেমে গেলো, ট্রেন ছেড়ে দিল।
আমরা দুজনে জীবনে প্রথম, আর শেষ, ইলিশ মাছ ভাজা, ডাল দিয়ে ভাত। তার পর আলু পোস্ত, আর শেষে মাছের কালিয়া দিয়ে ভাত খেলাম। শেষ করলাম রসগোল্লা দিয়ে।
সকালের প্যাকেট সকালে খোলা হলো। ময়দার লুচি, আলুর দম, ডিম সেদ্ধ, লাংচা।
দুপুরের প্যাকেট টা খোলা হল। এতে পরোটা, সাক ভাজা, আর সন্দেশ।
সেদিন কারো কাছে মোবাইল ফোন ছিল না যে ফটো তুলে রাখা হবে অথবা তৎক্ষণাৎ কথা বলা হবে। বাবু বেশ কবার বললেন, "বুঝলে অনুপ, সামাজিক কাজ করতে আর সংস্থা চালাতে গেলে ভিন্ন মতের প্রকাশ হতেই পারে। সেটা আমার তোমার হোক, বা কারোর, কিন্তু সদানন্দ যে ভাবে আমাদের খাবার ব্যাবস্থা করলো, এটা আন্তরিকতা ছাড়া আর কিছু না। এই যে আমরা এক সপ্তাহ আগে তুমুল বিরোধিতা করলাম, আর আজ যখন বন্ধু হিসেবে ওকে বললাম, ও একদম প্রাণের বন্ধু হিসেবেই কাজ করলো।"
"ঠিক বলেছেন বাবু, আমার এখনও অনেক কিছু শেখার আছে। সদানন্দ দাদা আমার আপনার আর আমাদের গ্রুপ এর মত থেকে ভিন্ন মত রাখে, অনেক সময় ভাবতাম ওনার কি কিছু মতলব আছে। আজকে শিখলাম মতের পার্থক্য কে মনের পার্থক্য তে আনার কোনো মনে হয়ে না।"
দিল্লী পৌঁছে সদানন্দ 'র বাড়ি তে ফোন করে দুজনে ধন্যবাদ জানালাম। খানিক গল্পঃ করার পর উনিই বললেন, "অনুপ ভাই, আগামী সভা তে আমি কিন্তু তোমার বিরোধিতায় নামবো, সামলে থেকো।"
আমি ও হেঁসে জবাব দিলাম "ঠিক আছে, তারপর বিকেলের চা আর মাংসর চপ আমার দিক থেকে পার্টি ।"
আজ ওনারা কেউ নেই, সতীর্থ রা অনেকেই নেই। শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে। সেই সব কর্ম শিক্ষা গুরু দের মনে করি, মনে করি যে ট্রেন'এ এরকম এলাহী খাবার জীবনে সেই একবার।
অনুপ মুখার্জী "সাগর"
Comments
Post a Comment